করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরণের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। আমি করোনায় আক্রান্ত হবো কিনা, আমি নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষা করতে পারবো কিনা, আবার করোনায় আক্রান্ত হলে এর কোন সঠিক চিকিৎসা আছে কিনা, শেষ পর্যন্ত আমার অবস্থা কী হবে- এই ধরণের চিন্তাগুলো মানুষের মনে কাজ করছে।
আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় ২১%, এই বিষয়টিও মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। করোনা যেমন মানুষের মনে উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে তেমনি ক্ষতির সম্ভাবনাগুলোও যেমন: মরে গেলে পরিবারের কী হতে পারে, ঘরে বসে থাকার ফলে সব ধরণের কাজ, ব্যবসা-বানিজ্য সব বন্ধ, ফলে ভবিষ্যতে কী হবে ইত্যাদি মানুষের মনে চিন্তার সৃষ্টি করছে। ভয় আর আতঙ্ক থেকে অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত রোগ হতে পারে, আর ক্ষতির সম্ভাবনার চিন্তা থেকে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা বিষন্নতাজনিত রোগ হতে পারে। আবার ভয় থেকে ফোবিক ডিসঅর্ডার হতে পারে।
এসময় বার বার হাত ধোয়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হচ্ছে, এর ফলে মানুষের মনে হাত ধোয়া নিয়ে এক ধরণের অবসেশন তৈরি হতে পারে বা যার আগে অবসেশন ছিল তা বেড়ে যেতে পারে এবং অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার হতে পারে। অনেকের তীব্র মানসিক চাপ থেকে উদ্বেগ, বিষন্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের লক্ষণ একত্রে দেখা দিতে পারে। করোনা পরিস্থিতির পর অনেকের অতীতের স্মৃতি থেকে পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। মানসিক সুস্থতার উপর শারীরিক সুস্থতা নির্ভর করে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষন্নতা, অনিশ্চয়তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ. উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে সেগুলো বেড়ে যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে করোনা ভাইরাস সহজেই কাবু করে ফেলবে।
আবার যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো আছে এবং যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মানসিক চাপের কারণে কমে গিয়েছে, তাদের দুইজন যদি করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে, তবে যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো আছে সে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে আক্রান্ত নাও হতে পারে। কিন্তু যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মানসিক চাপের কারণে কমে গিয়েছে, সে একইরকম সংস্পর্শের ফলে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। কোন করোনাক্রান্ত ব্যক্তির যদি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ. উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমার মতো রোগগুলো অনিয়ন্ত্রিত থাকে তবে করোনায় ক্ষতি হওয়ার বা মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা বেশি। করেরানা পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অনেক জরুরী। কারণ মানুষের মধ্যে যদি মানসিক চাপ, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও বিষন্নতা কাজ করে তবে সহজেই করোনা কাবু করে ফেলবে। আবার অনেকদিন ধরে ঘরে থাকার ফলে মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে, অন্যদের সাথে ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হতে পারে।
সুতরাং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, করোনা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য, অন্যান্য যেসব রোগসমূহ আছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্যে, মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বা মেন্টাল হেল্থ সাপোর্ট জরুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থা অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতির পর, বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগ মহামারীর মতোই দেখা দিবে এবং আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ২০% মানুষের মধ্যে মানসিক রোগ দেখা দিয়েছে এবং এর সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাই এখন থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অনেক জরুরী। সর্বক্ষেত্রেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জরুরী।
শিশুদেরকে এই পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে উৎফুল্ল্য রাখতে হবে। আবার যারা বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ, তাদেরকেও মানসিকভাবে উৎফুল্ল্য রাখতে হবে কারণ তাদের মৃত্যুভয় এমনিতেই বেশি এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্কদের মৃত্যুহার বেশি। যারা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, ভলান্টিয়ার তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তাঁরাই যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেন, তাহলে সেবা কার্যক্রম ব্যহত হবে। তাদের সমালোচনা না করে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে হবে। কারণ অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রনোদনার মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে।
যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে আছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। কারণ তাঁরা প্রতিনিয়ত পরিবার-পরিজন ছেড়ে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও যারা সংবাদকর্মী আছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।সংবাদকর্মীরা যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, তবে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন না।কারণ সংবাদকর্মীরাই এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে সবকিছু তুলে ধরবেন এবং আমাদের উব্দুদ্ধ করবেন। তাই সর্বক্ষেত্রেই মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বা মেন্টাল হেল্থ সাপোর্ট জরুরী।
শ্রুতি লিখন: খুশবু তাহসিন