দু’দিন আগে একদম হঠাৎই আত্মহত্যা করলেন বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুত। তার উত্থানের শুরু ছিলো ‘পবিত্র রিস্তা’ নামে এক জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিয়াল। যেটা দেখার কারণে ওনাকে জানতাম আগে থেকেই। তার মৃত্যুর পর থেকেই ফেসবুক জুড়ে যেন মাতম চলছিলো , মনে হচ্ছিলো যেন আর কোনো সংবাদ নেই চারিদিকে!
হয়তো বা এই অল্প বয়সে তার হঠাৎ মৃত্যু- এ কারণেই আলোচনা, লেখালেখি হচ্ছে বেশী। এই আত্মহত্যা কেন এবং এর কারণগুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতি হচ্ছে…যে কমন প্রশ্ন গুলো সবার মধ্যে,সেগুলো হচ্ছে-
- এত অল্প বয়সে (৩৪ বছর) কেন আত্মহত্যা?
- এত যশ,খ্যাতির চূড়ায় ওঠতে ওঠতে কেন নিজেই পিছলে পড়ে যাওয়া?
- জ্বলজ্বল করা এক তারকা সে,ভবিষ্যতে মহাতারকা হবার হাতছানি উড়িয়ে দেয়া যায় না… সব আছে,তাও কেন এ আত্মহত্যা?
ইত্যাদি প্রশ্ন মানুষদের মাঝে।
ব্যাক্তিগত ভাবে আমার পছন্দের অ্যাক্টর হলেও আজ আমার লেখায় সুশান্তকে আনার উদ্দেশ্য তার আত্মহত্যার যে সম্ভাব্য কারণ ,সেটা নিয়েই। প্রাথমিক তদন্তে ওনার বাসায় এন্টি ডিপ্রেসেন্ট ( বিষন্নতার ওষুধ) পাওয়া গেছে,আর জানা গেছে গত ছয় মাস বা তার বেশী সময় ধরে তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন,ওষুধ নিচ্ছিলেন,এবং এই লক ডাউন সময়ে গত কিছুদিন ধরে তিনি বাসায় একাই ছিলেন।এই প্রসঙ্গেই আজ লিখবো।
কোভিড-১৯ এক ভয়াবহ দূর্ভাবনার নাম। পুরো বিশ্বকে গত কয়েকমাসে ছিন্নভিন্ন করে চলেছে সে। কি স্বাস্থ্যগত,অর্থনৈতিক, মানসিক সব দিকেই তার এফেক্ট। বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেছে যে লকডাউন পরিস্থিতি কোভিড -১৯ ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। সেটা কিভাবে?
- লকডাউনের কারণে লোকেরা ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হয়, এই বিধিনিষধ তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধার সৃষ্টি করছে,তারা মনে করছে তারা তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
- পেশা এবং পেশাগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত, চাকরিগুলি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অনেকেই চাকুরীর ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকছেন।
- বাড়ি থেকে কাজ করার অস্থায়ী বেকারত্ব, বাচ্চাদের হোম-স্কুলিং এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সাথে শারীরিক- মানসিক যোগাযোগের অভাবের মুখোমুখি হওয়া।
- আত্মীয়-পরিজন, প্রিয়জন দের সাথে দীর্ঘদিনের অসাক্ষাৎ।
- নিঃসঙ্গতা,যার প্রধান কারন লকডাউন পরিস্থিতির কারণে পরিবারের কাছে থাকতে না পারা,কাজে না যাওয়া ইত্যাদি।
গবেষনায় দেখা গেছে লক ডাউন বা কোয়ারেন্টাইনের অব্যাহত বিধিনিষেধগুলি নিঃসঙ্গতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যাঁরা নিঃসঙ্গ থাকেন তাদের পক্ষে সমস্ত কারণ থেকে মৃত্যু ১৫% – ২৯% এর মধ্যে বৃদ্ধি করতে পারে।
একটি ছয় মাসের লকডাউনের সাথে নিঃসঙ্গতা যুক্ত হলে অতিরিক্ত ৪০১৫ মৃত্যু বেড়ে যেতে পারে। এই বর্তমান মহামারী এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে সাধারণত নিম্নোক্ত মানসিক সমস্যাগুলো বেশী দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-
১। ডিপ্রেশন ( বিষন্নতা বা অবসাদ)
২। অ্যাংজাইটি ডিজওর্ডার ( উদ্বেগ)
৩। ওসিডি
৪। একিউট স্ট্রেস ডিজওর্ডার
৫। পিটিএসডি ইত্যাদিই প্রধান।
আর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যারা আগে থেকেই কোনো মানসিক রোগে ভুগছিলেন,তাদের মানসিক রোগের লক্ষন গুলো ক্ষেত্র বিশেষে বেড়ে যাওয়া।কারন এই করোনা পরিস্থিতিতে অব্যাহত মানসিক চাপ,কর্মহীনতা,ঘরবন্দী অবস্থা ইত্যাদি কারনে মানসিক রোগের রিলাপ্স,রিকারেন্স এবং রোগের তীব্রতা ও বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে লক ডাউন পরিস্থিতিতে ডিপ্রেশনের হার ১৫-৩৫ বয়সীদের মধ্যে সর্বাধিক।ইউকে ভিত্তিক আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে লক ডাউন অবস্থা ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটি ডিজওর্ডারের হার যথাক্রমে ৩৮% এবং ৩৬%।
এই বিষন্নতাই হচ্ছে সেই কালপ্রিট,যার তীব্রতা একটি মানুষকে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করতে পারে।
অনেকে ভেবে থাকেন খুব মন খারাপ,কিচ্ছু ভালো লাগেনা… এগুলো থাকলেই বুঝি ডিপ্রেশন।হ্যাঁ, এগুলো ডিপ্রেশনের কয়েকটি লক্ষনের একটি। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু লক্ষন ও পরিবর্তন থাকে যা দিয়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বুঝতে পারবেন, রোগী ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
ডিপ্রেশনে একজন রোগীর মস্তিস্কে কিছু পরিবর্তন ঘটে,সাথে জেনেটিক,পরিবেশগত,সামাজিক, মনো-দৈহিক কারন ও থাকে। তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়।
⇨সাধারণত বিষন্নতায় একজন রোগী নিম্নলিখিত লক্ষন দেখা দেয়ঃ
- মন খারাপ থাকা, কিছুই ভালো না লাগা,কোনো কাজে আনন্দ না পাওয়া।
- খাবার রুচি,ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া।
- অত্যধিক দূর্বলতা, সাইকোমোটর রিটার্ডেসন।
- মনোযোগ কমে যাওয়া,জীবনটা অর্থহীন লাগা,নিজেকে অপরাধী ভাবা,নেতিবাচক চিন্তা।
- সিভিয়ার ক্ষেত্রে আত্মহত্যার চিন্তা বা চেস্টা।
ডিপ্রেশনে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অনেক পরিবর্তনের মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষন হচ্ছে নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা এবং বিশ্বাস ( যাকে negative cognition ও বলা হয়), যা তার বর্তমান কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করে ফেলে।যেমন রোগী নিজেকে নিয়ে,ভবিষ্যৎ,এবং পৃথিবীর সবকিছু নিয়েই নেতিবাচক চিন্তা করে এবং সে নিশ্চিত ভাবেই ভেবে নেয় ( যদিও বাস্তবে সেটা সত্য নয়।হয়তো বাস্তবে অনেকের কাছেই সে সফল,তার হয়তো অর্থ- বিত্ত সবই আছে) সে মূল্যহীন, তাকে সবাই তুচ্ছ করে,তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তার জীবনটাই অর্থহীন… এবং সে মনে করে মৃত্যুই একমাত্র সমাধানের পথ,আত্মহত্যাই তাকে মুক্তি দিতে পারে।
এই যে ডিটেইলে একটা মাত্র লক্ষনকে একটু বিশ্লেষণ করলাম,অনেক ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক চিন্তাটাই কিন্তু ডিপ্রেসড পারসনকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়।এই চিন্তা গুলো সুস্থ মানুষেরা করবে না সাধারণত, বা সুস্থ মানুষের মাথায় একবার এই চিন্তা আসলেও পরক্ষনে সে এটাকে সমর্থন করবে না। তাই কিছু করণীয় আছে আপনার-
⇨আপনার বা আপনার কাছের মানুষের মধ্যে যদি বিষন্নতার লক্ষন দেখেন,
- প্রথমেই জানান সে একা নয়,আপনি- আপনারা সবাই তার সাথে আছেন।
- তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে,তার সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য।
- ডাক্তারের দেয়া নিয়ম মতো ওষুধ ঠিকমতো নিচ্ছে কি না,খেয়াল রাখা।ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি দরকার হয় প্রয়োজনে,সেটা নিতে হলে রোগীকে সাইকোথেরাপি সেশন ঠিকমতো নিতে উৎসাহিত করা।
- তাকে ক্রিটিসাইজ করা যাবে না এই বলে,”তোমার কেন ডিপ্রেশন হবে,কিসের অভাব তোমার,বা নাম- যশ- খ্যাতি সব আছে তাও কেন সমস্যা ইত্যাদি।
- পরিবার- আত্মীয় – বন্ধুদের রোগীর প্রতি সহমর্মি থাকা।
- যদি রোগী আত্মহত্যার চিন্তা করেন, তবে সেটা সিরিয়াসলি নেয়া,রোগীর ডাক্তারের সাথে কথা বলা,রোগী যাতে নিঃসঙ্গ বা একদম একা না থাকেন সেটা খেয়াল রাখা।
- লকডাউন অবস্থায় টেলি মেডিসিন/ টেলি সাইকিয়াট্রি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।এতে আপনি বাসায় বসেই ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করতে পারবেন ভিডিও কলে।
⇨আর কেউ যদি এই লকডাউন অবস্থায় নিজে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন মনে করেন,তবে তিনি নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন-
- মনে রাখবেন,আপনি একা নন. অন্যান্য অনেক লোকও আজ এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আজ তারা বেঁচে আছে,সুস্থভাবেই।
- আত্ম-ক্ষতি বা আত্মঘাতী চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনাগুলির একটি থাকা গুরুতর মানসিক কষ্টের লক্ষণ (সম্ভবত কোনও প্রিয়জনের ক্ষতি, কর্মসংস্থান হ্রাস, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, বা অন্য কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা)। এতে আপনি নিজেকে দোষারোপ করবেন না এবং এটি কারওর সাথেই ঘটতে পারে।
- আপনার কেমন লাগছে সে সম্পর্কে কোনও বিশ্বস্ত পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা সহকর্মীর সাথে কথা বলুন।
- আপনি যদি নিজেকে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্থ করার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে থাকেন বলে মনে করেন জরুরি পরিষেবাগুলি বা কোনও সঙ্কট লাইনে যোগাযোগ করুন বা সরাসরি সেখানে যান।
- একজন পেশাদারের সাথে কথা বলুন যেমন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ বা কাউন্সিলরের সাথে।
সর্বোপরি সবাইকেই মনে রাখতে হবে এই মহামারী এবং লক ডাউন পরিস্থিতি আজীবনের জন্য নয়।অনেক দেশই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসছে,আমাদের ও স্বাভাবিক সময় আসবে।এই কঠিন সময় ধৈর্যের এবং সাহসিকতার সাথে পার করতে হবে।পরিবার এবং প্রিয়জনদের সাথে না থাকলেও ফোনে,ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখতে হবে,সমস্যা শেয়ার করতে হবে,নিজের স্বাভাবিক কাজকর্মের পাশাপাশি নিজের জন্য আনন্দদায়ক, এমন কাজ করলে মনটা ভালো থাকবে।মানসিক সমস্যা বেশী পীড়াদায়ক মনে হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
জেনে রাখবেন,মানসিক রোগ ও শারীরিক রোগের মতই একটি রোগ মাত্র।যেটা চিকিৎসাতেই ভালো হবে।”মানসিক রোগ মানেই পাগল”… এই স্টিগমা থেকে বের হবার এখনই সময়। মানসিক রোগের প্রতি আপনার নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির কারনে যদি আপনি আপনার ডিপ্রেসড প্রিয়জনকে সঠিক চিকিৎসা না করান… ফলে যদি তার জীবনের সমাপ্তি হয় আত্মহত্যার মাধ্যমে।নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে,এবং এই আত্মহত্যার একটি প্রধান কারণ ডিপ্রেশন। তাই সচেতন হোন।
সেদিন ঝলমলে রোদেলা দিনে বিকেলের দিকে হঠাৎই ঝড়…। যদি মৃত্যুর পর দেখা যেত,তাহলে এই হঠাৎ ঝড় দেখে সুশান্ত সিং রাজপুত ভেবে নিতেই পারতেন….প্রকৃতি ও আজ ভীষণ বিষন্ন,তার এ চলে যাওয়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন