কৈশোরকালে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

কৈশোরকালে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

কৈশোর বলতে আমরা সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাকে ধরা হয়ে থাকি। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সই টিনএজ কৈশোর বলা হয়। এটা এমন একটা বয়স, যেখানে ছেলেমেয়েরা শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। তাই এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ অনেকে বুঝতে পারে না তাদের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিতে হবে। তাই কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা নানা রকম মানসিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে।

একই সময়ে পরিবারের পাশাপাশি কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা তাদের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব এবং তারা যাদের পছন্দ করে থাকে, এমন মানুষদের চিন্তা ও ব্যবহার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। যা তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

এদিকে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে (কোভিড-১৯) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপ ও হতাশা বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১২ শতাংশ শিশু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। করোনায় এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশে ৪ শতাংশ ছেলে এবং ৬ শতাংশ মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা আছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা মানুষদের মধ্যে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশের চিকিৎসার সুযোগ নেই। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নেই বললেই চলে।

আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই, করোনায় সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। কিশোরেরা অবসাদ, উৎকণ্ঠা, মৃত্যুভয়, মা-বাবাকে হারানোর ভয় এবং হাসপাতালে একা থাকার আতঙ্কে ভুগছে—এই সবকিছু শিশুদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বর্তমানে আমাদের জীবনে খুব পরিচিত একটি শব্দ হচ্ছে স্ট্রেস। স্ট্রেসের কারণে কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও অবসাদ, উদ্বেগ, প্যানিক অ্যাটাক, পিটিএসডি, মুডের সমস্যা, ঘুমের সমস্যাসহ নানা উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।

বেশির ভাগ কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা তাদের বন্ধু হিসেবে ডিভাইস যেমন: মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটারকে বেছে নিয়েছে। দিনের অনেকটা সময় তারা পার করছে অনলাইন গেম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। এতে তাদের মধ্যে ডিভাইসের প্রতি আসক্তি দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যবহার, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, কোন পরিস্থিতি কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন: পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা, লম্বা সময় বাসায় থাকার কারণে মা–বাবার বাসা থেকে কাজ করা, বাবা ও মায়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, তাঁদের চাকরি হারানোর ভয়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও হতাশা, পরিবারের সদস্যদের অসুস্থ হওয়া, নিজের অসুস্থ হওয়ার ভয়, মা–বাবার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী টিনএজাররা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের জন্য যা করতে পারে:

উদ্বিগ্ন হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া

মহামারির সময়ে উদ্বিগ্ন হওয়া খুব স্বাভাবিক, এ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমরা কিছু বিষয় খেয়াল রাখব। যেমন: হাত ধোয়া, ভিড় এড়িয়ে চলা। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং অন্যকে সুস্থ রাখতে পারি। কোভিড–১৯ কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য মারাত্মক নয় এবং চিকিৎসার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেকে সুস্থ করতে পারি। এ বিষয়ে খেয়াল রাখলে ও জানলে আমাদের উৎকণ্ঠা কমাতে সাহায্য করবে।

অন্য কাজে মন দেওয়া

একই চিন্তা না করে মনকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখা। যেমন: হোম ওয়ার্ক করা, মুভি দেখা বা গল্পের বই পড়া, গান শোনা, ড্রয়িং করা, আগ্রহ তৈরি হতে পারে এমন যেকোনো কাজে অংশ নেওয়া।

বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন মাধ্যম খোঁজা

যেমন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। অভিভাবকের মতামত নিয়ে সীমিত সময় ব্যবহার করা। কারণ, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম অনেক ক্ষতির কারণ হতে পার।

নিজের অনুভূতিকে বোঝা

পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, শখ মেটানো ইত্যাদি। আর খেলাধুলা করতে না পারলে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক, এটা মেনে নিলেই ভালো হয়। মনে রাখতে হবে, সবকিছু সব সময় মনের মতো নাও হতে পারে। আমরা সুন্দর চিন্তার মধ্য দিয়ে তা মনের মতো করে নিতে পারি।

কৈশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশে বাবা-মায়েরা যেভাবে সহযোগিতা করতে পারেন

মা-বাবা বা অভিভাবকেরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে ভালোভাবে তাঁদের সন্তানদেরও যত্ন নিতে পারবেন। তাঁরা সন্তানদের সঙ্গে কোভিড–১৯ নিয়ে কথা বলবেন, একসঙ্গে বসে টিভি দেখবেন, তাতে কোভিড-১৯ এবং কোয়ারেন্টিন নিয়ে ওদের ভয় অনেক কমে যাবে। ওরা মা–বাবা বা অভিভাবকদের চোখে–মুখে উৎকণ্ঠা দেখলে তারাও সেভাবে আচরণ করবে। আপনার জীবনের সাফল্যের গল্পটি সন্তানকে শোনান। মনে রাখতে হবে, মা–বাবা সন্তানের অনুপ্রেরণার বড় উৎস।

স্কুল এবং শিক্ষকদের ভূমিকা

এই সময়ে স্কুল এবং শিক্ষকদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্কুলের শিক্ষকেরা নানা রকম গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁরা কোভিড ১৯ সম্পর্কে ছাত্রদের ইতিবাচক উপায়ে আলোচনা করতে পারেন। অনলাইনে ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুণগত কাজে অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারেন।

শিশু-কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কাজেই মনোযোগ দিতে হবে তাঁদের যথাযথ মানসিক বিকাশের ওপর। মা–বাবা যদি তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কোনো প্রকার মানসিক সমস্যা দেখতে পান এবং সন্তান যদি তার কোনো সমস্যা আলোচনা করে থাকে, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।

Previous articleমনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম: পরস্পরের প্রতি মনোভাব এবং প্রভাব বিষয়ে জরিপ চলছে
Next articleসর্বদা অন্যদেরকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা মোটেও বুদ্ধিদীপ্ত কোন কাজ নয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here