ঘটনা-১
তানিয়া (প্রকৃত নাম নয়) ২৬ বছর বয়সী একজন গৃহিনী। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর দেখা গেল সে আর তার দুই হাত নাড়াতে পারছেনা। অর্থাৎ দুই হাত প্যারালাইজড হয়ে গেছে। নিউরোলজী বিভাগে তাকে ভর্তি করানোর পর সব রকম পরীক্ষা করেও কোনো কিছু পাওয়া গেল না। তখন তাকে সেখান থেকে সাইকিয়াট্রি বিভাগে পাঠানো হলো। ডাক্তার দেখে ঔষুধ দিলেন এবং পাঠালেন একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর কাছে সাইকোথেরাপির জন্য। রিপোর্টে দেখা গেল, তানিয়াকে তার স্বামীর যৌথ পরিবারের সকল কাজ করতে হতো, যেমনঃ রান্না-বান্না করা, কাপড় কাচা, বাসন-কোসন ধৌত করা ইত্যাদি। সে চাইতো সবাই যে যার কাজ করুক, কিন্তু স্বামীর ভয়ে সে তাকে কিছু বলতে পারতো না। আবার এগুলো সে মন থেকে করতো না, যার ফল হল এই প্যারালাইসিস।
ঘটনা-২
ফারহানা (প্রকৃত নাম নয়) ২১ বছর বয়সী একজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী। তার এইচ.এস.সি পরীক্ষার আগের দিন হঠাৎ মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সবাই তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তার তুই চোখ বন্ধ, কিন্তু মিটমিট করছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর সবার কথা শুনছে। অনেক ডাকাডাকি কিংবা চোখে পানির ঝাপড়া দিয়েও কোনো কাজ হলো না। মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে তাকে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে পরীক্ষা করে দেখলেন সে কনভার্সন ডিজঅর্ডার রোগে ভুগছে।
ঘটনা-৩
জাকিয়ার (প্রকৃত নাম নয়) বয়স ১৯ বছর। একবছর আগেও সে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। জাকিয়ার বাবা মা দুজনেই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। প্রায়ই তাকে একা থাকতে হতো, যেটা তার পছন্দ না। জাকিয়ার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল তার বাবা কারণ বাবা তাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মেয়ের কোনো আবদার তিনি অপূর্ণ রাখতেন না। কিন্তু একবছর আগে হঠাৎ জাকিয়ার বাবা মারা যায়। বাবাকে ছাড়া জাকিয়া কোনোভাবেই নিজেকে কল্পনা করতে পারে না। বাবা তার সকল ইচ্ছাই পূরণ করতেন এবং তাৎক্ষনিকভাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা চেষ্টা করতেন তার আবদারগুলো পূরণ করতে। কিন্তু তার একার আয়ে সেটা আর হয়ে উঠতো না। তাছাড়া তার ছোট আরেকটি ছেলেও ছিল। একদিন জাকিয়া তার মায়ের কাছে একটি স্মার্টফোন চাইল। কিন্তু মা দিতে চাইলেন না। এটা নিয়ে মায়ের সাথে রাগারাগি শুরু হল এবং একপর্যায়ে জাকিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। মিনিট বিশেক পর তার জ্ঞান ফিরে এল। তার পর থেকে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই সে অজ্ঞান হয়ে যেত এবং পরীক্ষার আগে মুখ দিয়ে কথা বের হতো না। এভাবে কিছুদিন যাবার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো এবং দেখা গেল জাকিয়া কনভার্সন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
কনভার্সন ডিজঅর্ডার কি?
কনভার্সন ডিজঅর্ডার হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি অন্ধত্ব, প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া, কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়া, খিচুনী হওয়া এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক অকার্যকারিতার সম্মুখীন হন, যা চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রচলিত পরীক্ষাগুলোর দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই রোগে ব্যক্তির সংবেদী (Sensory) ও অঙ্গসঞ্চালন মূলক বিকৃতি দেখা দেয় যেগুলো স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষয়-ক্ষতির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয়। কিন্তু নিউরোলজিক্যাল বিভিন্ন টেষ্টে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনা। মেডিকেল ইনভেস্টিগেশন এর মাধ্যমে নিউরোলজিক্যাল ও মেডিকেল কারণ গুলোকে বাদ দেওয়ার পরই শুধুমাত্র কোনো রোগীকে কনভার্সন ডিজঅর্ডার রোগী হিসেবে ডায়াগনোসিস করা হয়। এই রোগের লক্ষণগুলো ধারাবাহিক নয়। যেমনঃ যখন রোগীদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয় তখন লক্ষণগুলো আরো বেড়ে যায়।
কনভার্সন ডিজঅর্ডার এর লক্ষণসমূহ
এই রোগের নানা ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। তার মধ্যে বাংলাদেশে লক্ষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়-দুই হাত প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া, কোমর পর্যন্ত অবশ, দুই পা অবশ হতে পারে, কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হওয়ার কারণে ফিসফিস করে কথা বলা, সাময়িকভাবে কথা বলার ক্ষমতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল- ভারসাম্যহীনতা, নির্দিষ্ট অঙ্গে দূর্বলতা, কোনো কিছু গিলতে সমস্যা দেখা যেতে পারে, গলায় কিছু আটকে আছে বলে মনে হওয়া ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা যায়, রোগী ঢেউয়ের মতো হাত নাড়াতে নাড়াতে দেহকে অনিয়মিতভাবে কাঁপিয়ে, ঝাঁকুনি দিয়ে হাঁটে। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাবে। তবে সাধারণত তারা পড়ে যায় না। যদি পড়েও যায়, তবে এমনভাবে পড়ে, যাতে দেহে কোনো আঘাত না লাগে।
আবার অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে দেখা যায়- শরীরে খিচুনী হওয়া, স্পর্শানুভূতিহীনতা, ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলা, কেউ কেউ শরীরে পিন ফোটানোর মতো অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। হাত-পায়ের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, বারবার চোখের পলক পড়া, জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখা, ঘাড় বাঁকা করে থাকা এবং বমি করা বা বারবার বমির চেষ্টা করা, প্রসাব পায়খান বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণও থাকতে পারে। রোগের লক্ষণগুলো নিয়ে তাদের স্বজনদের মধ্যে যতই উত্কণ্ঠা থাকুক, রোগী নিজে কিন্তু অনেকটা বিকারহীন থাকে। কোনো কিছুকে ডাবল দেখা, কারো কারো দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে, অন্ধত্ব, বধির হয়ে যাওয়া এবং হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
কখন হয় ও কাদের হয়?
কনভার্সন ডিজঅর্ডার সাধারণত কৈশোরে (late childhood) অথবা যৌবনে দেখা দেয়। তবে ১০ বছরের আগে ও ৩৫ বছরের পরে হয় না বললেই চলে। তবে ৯০ বছর বয়েসেও এই ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হবার তথ্য পাওয়া গেছে। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের প্রায় ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে শরীরের ডান পাশের চেয়ে বাম পাশে লক্ষণগুণ বেশি দেখা যায়।
এ রোগের প্রাদুর্ভাব
কনভার্সন ডিজঅর্ডারের হার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন রকম। তবে প্রতি লাখে ১১ জন থেকে ৩০০ জনের এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত গ্রাম্য মানুষের বেশি হয়। এছাড়া যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিম্ন এবং মেডিকেল ও মানসিক রোগ সম্পর্কে ধারণা কম তাদের মধ্যে বেশি হয়। যে কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রাদুর্ভাব বেশি।
কার্যধারা
কনভার্সন ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো তীব্র হয় এবং ধীরে ধীরে লক্ষণ আরো বাড়তে থাকে। সাধারণত এই বিকৃতির লক্ষণগুলো সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী হয়। যাদেরকে এই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তারা সাধারণত ২ সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। বারে বারে লক্ষণগুলো ফিরে আসা খুবই স্বাভাবিক।
কনভার্সন ডিজঅর্ডারের সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু বিষয়
কনভার্সন ডিজঅর্ডারের রোগীদের ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে রোগীরা তাদের লক্ষণগুলো নিয়ে বিচলিত বা উদ্বিগ্ন নয়, এটাকে বলা হয় la bella indefference। আবার তাদের লক্ষণগুলো নাটকীয় বা অদ্ভুতভাবে হাজির হতে পারে। এসব রোগীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেও তাদের জিব বা ঠোঁট কেটে যায় না, কাপড়-চোপড়ে প্রস্রাব হয়ে যায় না, একা থাকলে বা ঘুমের মধ্যে কনভার্সন ডিজঅর্ডার রোগীর খিঁচুনি হয় না। কনভার্সনের সাথে আরো শারীরিক লক্ষণ উপস্থিত থাকতে পারে। এর সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু ডিজঅর্ডার হল Dissociative Disorder, MDD, Histrionic Personality Disorder, Antisocial Personality Disorder ইত্যাদি। (চলবে- কেন হয়, Assessment, Formulation, Beck’s Model of conversion disorder and Treatment )
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।