এনডিডি আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব কার?

0
42

ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

কে বলবে নিজের মনে খেলা করতে থাকা অসম্ভব রকমের নিষ্পাপ এই বাচ্চাটি অটিজমে আক্রান্ত!
এসেছিলাম নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারে ভোগা বাচ্চাদের নিয়ে করা একটা এনজিও ক্যাম্পেইনে। সাইকিয়াট্রি এবং শিশু ও নিউরোলজি বিভাগের ডাক্তাররা আসবেন, ফ্রি চিকিৎসা দিবেন একটা টিম হিসাবে। এটা শুনেই হয়ত দূরদূরান্ত থেকে কিছু বাবা—মা তাদের মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধী বলা বাচ্চাগুলো নিয়ে ছুটে এসেছেন একটু চিকিৎসার আশায়। নাকি বলবো কিছু আশার বাণী শোনার আকাঙ্ক্ষায়!
কথা হচ্ছিল বাচ্চাদের অভিভাবকদের সাথে। বাচ্চাদের চিকিৎসার আনুষঙ্গিক খরচ ছাড়াও স্পিচ থেরাপি, স্কুলে দিলে স্কুলের খরচ ছাড়াও সামাজিকভাবে আরো অনেক খরচের ব্যাপার আছে, যা কিনা মধ্যবিত্তদের জন্যও দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। আর যারা অল্প আয়ের মানুষ, তাদের কথা সহজেই অনুমেয়। আবার যাদের সামর্থর্ আছে তারা অনেকেই পাড়ি জমায় উন্নত দেশে এসব বিশেষ শিশুদের কিছু বাড়তি সুযোগ—সুবিধার আশায়।

সেমিনার সেশনে অনেকেই জিজ্ঞেস করল, চিকিৎসা ব্যবস্থা তো পাওয়া যায়, সরকারি হাসপাতালে বা এনজিওগুলোও এসব বাচ্চাদের ফ্রি চিকিৎসা দেয় অনেকসময়। কিন্তু বাকি সব? মানে বিভিন্ন থেরাপি, স্কুলের খরচ, অন্যান্য মেইনটেইনিং খরচ কীভাবে করবে এই বাবা—মায়েরা? এসব বাচ্চাদের লালন পালনে রাষ্ট্রের কি কোনো ভূমিকা কিংবা দায়িত্ব আছে?
রাষ্ট্রের ভূমিকা অবশ্যই আছে। এবং এধরনের দীর্ঘস্থায়ী কিংবা জীবনব্যাপী চলমান কোনো রোগ বা অক্ষমতার জন্য কোন রাষ্ট্র কী করে এবং আমাদের দেশে কী ব্যবস্থা আছে আমরা তা জানবো। তবে প্রথমেই জেনে নেই নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলতে কী বোঝায়।
নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (NDD) হলো একটা বহুমুখী অবস্থা অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা যা মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বিকাশের ফলে ব্যক্তির বা শিশুটির জ্ঞান, যোগাযোগ, আচরণ এবং মোটর দক্ষতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই সমস্যার কারণে অসুস্থ শিশুটি নিজের চলার ক্ষেত্রে এবং পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে যথাযথভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারে না।

উন্নত বিশ্বে, অর্থাৎ ইউএসএ, কানাডার মতো দেশগুলোয় সোশ্যাল সিকিউরিটি সার্ভিস এবং ন্যাশনাল বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে এসব রোগীদের চিকিৎসা প্রদানসহ তাদের রিহেবিলিটেশন ও পরিবারের বার্ডেন কমানোর বিভিন্ন পলিসি নেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকার কী করছে? আসুন জেনে নেই:
যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সকল অধিকার, মানবসত্ত্বার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। এখানে নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিভিন্ন ডিজঅর্ডার, যেমন অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (autism or autism spectrum disorder), বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা (intellectual disability), ডাউন সিনড্রোমসহ (Down syndrome), অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ও শারীরিক ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতাকে উল্লেখ করে তাদের চিকিৎসা ও অন্যান্য পুনর্বাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।
চলুন দেখে নেই বর্তমানে সরকারের কী কী কার্যক্রম চালু আছে-
১. Early Screening, Detection, Assessment I Early Intervention নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় পরিচালিত ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে।
২. অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর পিতা—মাতা/অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ : অটিজম সমস্যাগ্রস্ত সন্তানদের পিতা—মাতা/অভিভাবক ও কেয়ার গিভারদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
৩. বেসরকারি সংস্থা পর্যায়ে অনুদান প্রদান।
৪. জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে একটি সম্পূর্ণ অবৈতনিক স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম চালু করা হয়। পরবর্তিতে বিভিন্ন শহরে মোট ১২টি স্কুল চালু করা হয়েছে। উক্ত স্কুলগুলোতে অটিজম ও এনডিডি সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের অক্ষর জ্ঞান, সংখ্যা, কালার, ম্যাচিং, এডিএল, মিউজিক, খেলাধুলা, সাধারণজ্ঞান, যোগাযোগ, সামাজিকতা, আচরণ পরিবর্তন এবং পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়।
৫. এতিম ও ঠিকানাহীন প্রতিবন্ধী শিশুর লালন পালন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রতিবন্ধী শিশু নিবাস চলমান আছে।

সরকারি ছাড়াও বিভিন্ন দেশি—বিদেশি এনজিও প্রতিষ্ঠান ও এসব রোগীদের নিয়ে কাজ করছে। তবে সংখ্যা এখনো অপ্রতুল, অথবা তাদের দেয়া সেবাগুলো সর্বসাধারণের দ্বোরগোড়ায় এখনো হয়ত পেঁৗছায়নি। সেজন্য চলমান বিভিন্ন কার্যক্রম, সেবা ও প্রকল্পগুলো আরো বৃহৎ পরিসরে চালু করতে হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি এধরনের সংকট যেকোনো পরিবারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। সুতরাং উন্নত বিশ্বের মতো সরকারেরই এ বিষয়ে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। কেননা, উন্নত বিশ্বের পরিবারগুলো আমাদের থেকেও উন্নত জীবনযাপন করার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাদের কাছে এবং সরকারের কাছে মনে হয়েছে অটিজম শিশুদের সার্বিক দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত। সেক্ষেত্রে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের দেশে এটা আরো বেশি জরুরি। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি আরো ব্যাপক পরিসরে পূর্ণাঙ্গ পলিসি নির্ধারণ করে এধরনের শিশুদের চিকিৎসাসহ পুনবার্সন ও অন্যান্য খরচ নির্বাহে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিডিয়াসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

Previous articleবিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা কীভাবে?
Next articleডায়াবেটিস রোগীদের অ্যাংজাইটিতে ভোগার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here