ঋতুস্রাব বন্ধ: সমস্যা ও সমাধানের কথা

‘মেনোপজ’ শব্দটি একটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ, যা দিয়ে নারীদের ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে বোঝানো হয়েছে। এটি একটি হরমোনজনিত (ইস্ট্রোজেন) ক্রিয়া। এক বছর বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে যদি কারো মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বোঝা যায় তার মেনোপজ হয়ে গেছে। সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের এই মেনোপজ হয়ে থাকে এবং সঙ্গে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। নারীদের একটি নির্দিষ্ট হরমোন এই সময়ে দেহে তৈরি হওয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে যায়। তাই কিছু শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা অনেকেই অনভব করে থাকেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে কৈশোরে ঋতুমতী হওয়া, গর্ভকালীন সময়টি, মধ্যবয়সের মেনোপজের সময় এবং বার্ধক্য জীবনের শুরু- এই প্রতিটি অধ্যায় সমান গুরুত্ব বহন করে। তাই মেনোপজের এই সময়ের উপসর্গগুলো এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে প্রতিটি নারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকাটা জরুরি।

মেনোপজ দুই ধরনের। একটি স্বাভাবিকভাবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। আরেকটি হলো হিস্টেরেক্টমি অপারেশনের (জরায়ু ফেলে দেয়া) মাধ্যমে প্রকৃত বয়সের আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। যেভাবেই মেনোপজ হোক না কেন, উপসর্গগুলো একই রকমের হয়ে থাকে।

উপসর্গ
সম্পর্ণভাবে ঋতু বন্ধ হওয়ার আগে এক-দেড় বছর আগে থেকেই দুই ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। তা ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। প্রথমত শারীরিক, দ্বিতীয়ত মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। এই লম্বা সময়টিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাটা তাই বেশ জরুরি। শারীরিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা অনেকেরই আছে। তবে মানসিক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা নেই বললেই চলে। তাই শারীরিক সমস্যার সঙ্গে মানসিক অস্থিরতা যোগ হয়ে অনেক সময় জটিল সমস্যা তৈরি করে ফেলে।

শারীরিক উপসর্গ
এগুলো অনেকেই জানেন, তারপরও জানার সুবিধার্থে আরেকবার জেনে নিই। কারণ ৭৫% বা ততোধিক নারীর ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো নিয়মিতভাবে হয়ে
থাকে।

– হঠাৎ করে প্রচন্ড গরম অনুভূত হওয়া, ঘাম হওয়া, অস্থিরতা বোধ করা এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত ঘেমে শীতল অনভব করা। সাধারণত রাতের বেলা এগুলো বেশি বেশি হয়। ফলে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমটা প্রায় সময় নষ্ট হয়ে যায়। দিনের বেলাতেও এমনটা ঘটে। কিন্তু যেহেতু দিনের বেলা ঘুমের ব্যাঘাতের আশঙ্কা থাকে না, তাই তেমন খারাপ লাগে না। এই হঠাৎ ঘেমে যাওয়াটা কেবল মুখমন্ডল, ঘাড়, গলা এবং বকে হয়ে থাকে। শরীরের অন্য অংশে অনুভব হয় না।

-মাঝে মাঝে হার্টবিট খবু পরেই তা কমে যাওয়া।

– মেটাবলিজম বা বিপাক কমে যাওয়ার ফলে ওজন বেড়ে যাওয়া। এতে সাধারণত পেট, উরু, কোমরের ওজন বেড়ে যায়। ফলে হাঁটা-চলায় সমস্যা তৈরি করে।

– ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে প্রসাব চেপে রাখতে অসুবিধা বোধ করা এবং অনেক সময় কাপড় নষ্ট হয়ে যাওয়া।

– ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে হাড় ক্ষয় শুরু হয়। তাই কোমর, হাঁটু, মেরুদন্ড ও নানা জয়েন্টে ব্যথা দেখা দেয়। তবে যারা ব্যায়াম বা নিয়মমতো কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, শারীরিকভাবে তাদের এই ধরনের উপসর্গ কম হয়ে থাকে।

-ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেসের জন্য সহবাসে ব্যথা অনুভ‚ত হতে পারে। ফলে অনেকেই সহবাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

-ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে দেহে কোলেস্টেরলের আধিক্য দেখা দিতে পারে। যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, ওজন বেশি, শিথিল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তাদের সব মিলিয়ে হার্টেও সমস্যা হতে পারে।

এই উপসর্গগুলো শুরুতে খুব বেশি প্রকটভাবে দেখা দিলেও পরবর্তীতে এই উপসর্গের হার ধীরে ধীরে কমে আসে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থায় কিছুটা অভ্যাস হয়ে যায়। এগুলো যদি তীব্র আকারে দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক জীবনে নানা সমস্যা তৈরি করে, তখন তার প্রতিকারও আছে। গাইনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে এর প্রতিকার সম্ভব। তবে মেনোপজের আগেই ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত। বাড়তি ওজন হলে কমিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

মানসিক উপসর্গ
বেশিরভাগ নারী এই মানসিক উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানেন না। ফলে শারীরিক সমস্যার সঙ্গে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় বঝতে পারেন না

কোনো ডাক্তারকে দেখানো উচিত বা কী ধরনের চিকিৎসা নেয়া দরকার। নানা গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০-৭৫% নারী এই সময়ে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। কিন্তু স্বাভাবিক মন খারাপ ভেবে চিকিৎসার আওতায় আসেন না। এই সময়ে নারীদের যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে-
– বিষণ্ণতা
– অতিরিক্ত উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি
– মনোযোগ না দিতে পারা
– স্মৃতিশক্তি কমে আসা। পরবর্তীতে ডিমেন্সিয়া হয়ে যাওয়া
– ডেলুশনাল ডিজঅর্ডার (সন্দেহ প্রবণতা)
– ডেলুশনাল প্যারাসাইটসিস                                                                                              -রেস্টলেস এবং লেগ সিনড্রোম

ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে সেরেটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিন নিউরোকেমিক্যালের ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতার জন্য খিটখিটে মেজাজ, দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্ণ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই অনেক নারী মেনোপজের আগে থেকেই নানারকম মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সঙ্গে ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের সমস্যা মিলিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে যাওয়ার আগেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

কাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি
– সাধারণত যাদের প্রেগন্যান্সি বা সন্তান প্রসবের পর বিষণ্ণতা দেখা দেয়ার ইতিহাস আছে
– যাদের নিয়মিতভাবে মাসিক ঋতুস্রাবের  আগে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য বিষণ্ণতা দেখা দেয়ার ইতিহাস আছে
– যাদের হিস্টেরেক্টমি বা জরায়ু ও অভারি ফেলে দেয়ার ইতিহাস আছে
– যারা থাইরয়েড হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন
– যাদের ডায়াবেটিস আছে

এই প্রতিটি বিষয়ই হরমোনজনিত কারণে হয়ে থাকে। তাই এই ইতিহাস জানা প্রয়োজন। সঙ্গে থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করে দেখা এবং ডায়াবেটিসের প্রকার জানা ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

আলঝেইমারস ডিজিজ বা ডিমেনশিয়া
নারীদের নির্দিষ্ট হরমোন দুটি; একটি ইস্ট্রোজেন, অন্যটি প্রজেস্টেরন। মেনোপজের আগে থেকেই ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি শুরু হয়ে যায়। ফলে তা নারীদের ব্রেইনের ক্ষয় শুরু করে। একই সময়ে প্রজেস্টেরন হরমোনটি ব্রেইনের গøুটামেট কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়, যা ব্রেইনের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখার জন্য
কোলেনার্জিক রিসিপ্টরের ক্ষয় করে থাকে। ফলে এই দুই হরমোনের কার্যক্রমের জন্য নারীদের ডিমেনশিয়া হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। কারো যদি সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল থেকে থাকে, তাহলে এই ডিমেনশিয়া হওয়ার প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

ডেলশনাল ডিজঅর্ডার বা সন্দেহ প্রবণতা
যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে যে সন্দেহপ্রবণতা রোগ বা ডেলুশনাল ডিজঅর্ডার, তা বিশেষ কারো প্রতি হতে পারে বা সব বিষয়ে দেখা দিতে পারে। যদিও নারী- পুরুষ যে কারোরই এ রোগ হতে পারে। তবে মেনোপজের ঠিক আগে বা পরে নারীদের এই রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

ডেলশনাল প্যারাসাইটসিস
অনেক নারী বলে থাকেন, তাদের চামড়ার নিচে পোকা হাঁটছে এবং তারা তা টের পান। ফলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেন। এই কারণে অনেকে অস্থিরতায় ভোগেন এবং অনেক সময় তারা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু এটি আসলে একটি মানসিক রোগ, যার চিকিৎসা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই দিয়ে থাকেন।

ট্রাইকোটিলম্যানিয়া
নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার অস্বাভাবিক ইচ্ছাকে ট্রাইকোটিলম্যানিয়া বলা হয়ে থাকে। এটি ঋতু¯্রাব বন্ধ হওয়ার আগে বা পরে থেকে দেখা দিতে পারে। অনেক সময় এই রোগের সঙ্গে ডেলুশনাল প্যারাসাইটসিসও একই সঙ্গে দেখা যায়। এই দুটি রোগের জন্য রোগীরা সাধারণত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। তবে এই দুটি রোগই মানসিক রোগ।

রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম
ঠিক ঘমাতে যাওয়ার সময় বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পায়ে অস্বাভাবিক একটা অনুভ‚তি বোধ করা। পা নাড়লেই এই অনুভ‚তিটা দূর হয়ে যায়। তাই সারাক্ষণ পা নাড়তে গিয়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এটি কিডনি ডিজিজ, রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি, অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাবার ইত্যাদি কারণে হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা অজানা রয়ে গেছে।

সমাধান
হরমোনের ঘাটতির জন্য মেনোপজের সময় সাধারণত যেসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে নারিত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা, স্বামীর সঙ্গে সহবাসে অস্বস্তির আশঙ্কা, সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারানোর ভয়, অন্যান্য শারীরিক সমস্যার দরুন সৃষ্ট সমস্যাগুলো মিলিয়ে অনেক নারী অস্থিরতায় ভুগে থাকেন এবং বুঝে উঠতে পারেন না কোন চিকিৎসকের কাছে যাবেন বা কীভাবে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠবেন। শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলোর জন্য যে কোনো গাইনি বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেয়া জরুরি।

চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীকে এই সময়ে নানা উপসর্গ সম্পর্কেও ধারণা দেয়া যেতে পারে যে, তিনি যেসব বিষয়ে ভয় পাচ্ছেন বা অস্থিরতায় ভুগছেন সব নারীই একটা সময় এমন অভিজ্ঞতার মখোমুখি হয়ে থাকেন। এগুলো সেরে যাবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সেই সঙ্গে পরিবারের অন্যদের সহযোগিতামূলক মনোভাবটাও জরুরি। এতে রোগী আস্থা বোধ করেন এবং খুব দ্রæত সুস্থ হয়ে ওঠেন। রোগীর শারীরিক সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিলে অনেক সময় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দেয়া হয়। তবে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি কখনোই দীর্ঘ সময়ের জন্য নেয়া ঠিক নয়। দীর্ঘ সময় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে ক্যান্সারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে পারে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা হাঁটার অভ্যাস করলে ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

ফলে শারীরিক সমস্যা কমে আসে। রাতে ঢিলেঢালা পোশাক পরে শুতে যাওয়া, রেস্টলেসলেগ সিনড্রোমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনযায়ী নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট/ফলিক অ্যাসিড সেবন করা, রাতে ঘমানোর আগে কিছক্ষণ স্ট্রেচিং করে পা দটি হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঘুমাতে গেলে এই উপসর্গগুলো তীব্র আকারে কখনোই দেখা দেয় না। প্র¯্রাব ধরে রাখার জন্য ‘কিজেল ব্যায়াম’ বলে একটা বিশেষ ব্যায়াম শিখে নিয়ে নিয়মিতভাবে করলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। হাড় ক্ষয়রোধের জন্য নিয়মিত ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম খেতে হয় চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী। মানসিক রোগগুলোর জন্য অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি। অনেকের ধারণা, একবার মনোরোগের ওষ খাওয়া শুরু করলে কখনোই ছাড়া যায় না। এটি সম্পর্ণ ভিত্তিহীন। রোগের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসা নিলেই ভালো হয়ে উঠবেন নিশ্চিত। জীবনের প্রতিটি সময়ের আলাদা যত্ন, আলাদা নিয়ম থাকে। সেগুলো ঠিকমতো মেনে চললেই জীবন সহজ হয়ে ওঠে।

Previous article১৪ বছর বয়সের আগে সেলফোন নয়
Next articleভারতীয় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here