খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী ও নাট্য পরিচালক তিনি। মঞ্চ, টিভি, চলচ্চিত্র সর্বক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর সফল পদচারণা। পরিচালনা করেছেন বেশকিছু নাটক। নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন একাডেমি (বিএফটিএ) এবং বাচ্চাদের স্কুল ইচ্ছেতলা। তিনি স্বপ্ন দেখেন সত্য সুন্দর জ্ঞানময় পৃথিবীর। তিনি আফসানা মিমি। মনেরখবর পাঠকদের মুখোমুখি হয়ে এবার তিনি জানাচ্ছেন তাঁর মনের কথা, ভাবনার কথা, ইচ্ছের কথা, স্বপ্নের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ মামুন।
কেমন আছেন?
ভালো আছি।
কিভাবে ভালো থাকেন?
কাজ ভালোবাসি। আমি পরিশ্রমী মানুষ। আর সুচিন্তা করি। কুচিন্তা করি না। আমি খুব পজেটিভ থিংকার।
চারদিকে নেগেটিভ যে বিষয়গুলো রয়েছে এগুলো এড়িয়ে চলেন কিভাবে?
যখন দেখি কোনো মিথ্যা, অপ বা নেতিবাচক কিছু তখন আমি খুব দ্রুত সেখান থেকে সরে যাই। কখনও নেগেটিভিটি দ্বারা আক্রান্ত হলে আমার ভেতরের আমি আমাকে শাসন করে। মনকে আলোকিত করতে হবে। আর মনের আলো হচ্ছে জ্ঞান। আমার জীবনের বন্ধু হলো মানুষ আর বই। কখনও এমন হয় কোনো মানুষের থেকে দূরে সরে যেতে হয়, কিন্তু বই এর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা নেই। বই সবসময়ের বন্ধু। মনের অন্ধকার নিয়ে কখনও শুদ্ধতার চর্চা করা যায় না।
অবসরে কি করেন?
বই পড়ি। শুয়ে শুয়ে বই পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। তাছাড়া কাজের সময় অফিসে বসে বন্ধু-সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি কথা বলছি সেটাও তো এক ধরনের অবসর। আমি আড্ডা প্রিয়।
জীবন চলার প্রেরণা কোথা থেকে পান?
জীবনের প্রেরণার কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলবো কাজ থেকে, বই পড়া থেকে, ইতিবাচক চিন্তা এই তিনটি জায়গা থেকে আমি আমার প্রেরণা পাই।।
ইতিবাচক ভাবনা বা জীবনকে ইতিবাচক ভঙ্গিতে চালিত করার জন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতি আছে কি?
এটা আসলে একটা চর্চার বিষয়। এটা একটা লাইফস্টাইল। ভালো থাকবো, ভালো চিন্তা করব, মানুষকে কখনও ঠকাবো না, চারদিকের বিষয়গুলোকে ইতিবাচক ভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করব। যেমন আমি মানুষকে বিশ্বাস করি, যদিও অনেকে এটা করতে চান না ঠকে যাওয়ার ভয়ে।
ভয়টা তো অমূলক নয়, বিশেষ করে এই সময়ে?
হ্যাঁ, আজকের সময়টা খুব খারাপ। আমরা যে সময়টার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেখানে মানুষকে বিশ্বাস করে জীবনটা শংকার মুখে চলে যেতে পারে। বিশ্বাস করব মানে এই নয় যে ভালো-মন্দের বিচার করব না। যেমন একটা উদাহরণ দেই, পথে চলতে যদি কেউ আমাকে ধাক্কা দিলো তাহলে প্রথমবার আমি ধরে নেই ব্যাপারটা অসাবধানে ঘটেছে, কিন্তু দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেলে সাবধান হয়ে যাই। বুঝতে পারি সেখান থেকে আমার সরে যেতে হবে।
মনকে শুদ্ধ রাখার চেষ্টা করা যায় কিভাবে?
মনকে আলোকিত করতে হবে। আর মনের আলো হচ্ছে জ্ঞান। আমার জীবনের বন্ধু হলো মানুষ আর বই। কখনও এমন হয় কোনো মানুষের থেকে দূরে সরে যেতে হয়, কিন্তু বই এর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা নেই। বই সবসময়ের বন্ধু। মনের অন্ধকার নিয়ে কখনও শুদ্ধতার চর্চা করা যায় না।
বই পড়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু?
অবশ্যই খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ । তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও আমাদের পড়তে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ অনেক আলোকিত হন। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমরা যেখান থেকে নেব সেসব প্রতিষ্ঠানকেও হতে হবে যথাযথ।
যথাযথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান?
প্রতিষ্ঠান যদি এমন হয় যে পরিচালনা পরিষদে কে কত বেশি টাকা দিয়ে সদস্য হবে, কে কত বেশি টাকা দিয়ে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি করবে তাহলে সেটা তো কোনো সঠিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে বেশি লাভজনক করা যায় শুধু এমন ভাবনা ঠিক নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সেবমূলক ক্ষেত্র। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে শিক্ষা দেয় সেটাই হচ্ছে যথাযথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যথাযথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধারণাটি এই সময়ে দূর্লভ নয় কি?
এ প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতে যাই তাহলে আমার কথাটা অদ্ভুত শোনাতে পারে এবং কারো কারো দ্বিমতও থাকতে পারে। হ্যাঁ, আমাদের যথাযথ শিক্ষার ব্যাপারটি প্রায় ধ্বংসের মুখে। এবং এর জন্য মূলত দু’টি কারণ দায়ী বলে আমি মনে করি। প্রথমটি রাজনৈতিক কারণ। একটা রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরের স্তরে যখন কোনো অপচর্চা হয় তখন তার প্রভাব সবক্ষেত্রেই পড়ে। এবং এটা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয়টি একই দেশে নানামুখী শিক্ষা। একদিকে আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম, আরেকদিকে ইংরেজি মাধ্যম আবার আরেকদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। মাধ্যমগুলোর কোনটি ভালো কোনটি মন্দ সেটি বলছি না। আমি বলছি পড়াশুনার শুরুতেই যদি ছেলে/মেয়েরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায় তাহলে তাদের কাছ থেকে আমরা যদি আশা করি তারা এক হয়ে দেশ পরিচালনা করবে তাহলে সেটা হবে সোনার পাথর বাটি।
শিক্ষকরাও অনেকাংশে দায়ী নয় কি?
মূল যে দুটি সমস্যার কথা বললাম এর পাশাপাশি আরো দুটি সমস্যা হলো, শিক্ষক যখন ছাত্রকে ঠকাতে চায় তখন তো ছাত্রের আর কিছু পাওয়ার থাকে না। একজন ছাত্র সকালে স্কুলে যাবে তারপর বিকেল তিনটা হোক চারটা হোক স্কুলে থাকবে সেখানে শিখবে। কিন্তু কি দেখছি আমরা, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে আবার স্কুল থেকে ফিরেই যাচ্ছে কোচিং এ। তাহলে কি শেখাচ্ছে? যেখানে প্রয়োজন হয়তো চারটা বইয়ের সেখানে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে দশটা বই। কেন? সারা পৃথিবীর বাচ্চারা যদি চারটা পাঁচটা বই পড়ে বড় হতে পারে তাহলে আমাদের কেন দশটা বই লাগবে? সারা পৃথিবীর বাচ্চারা যেখানে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে হেসে খেলে, সেখানে আমাদের বাচ্চাদের কেন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়ার মধ্যে থাকতে হবে? শিক্ষাক্ষেত্র যদি হয়ে যায় বাণিজ্যিক চক্র, শিক্ষাক্ষেত্র যদি হয়ে যায় রাজনীতির ক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্র যদি হয়ে যায় নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থার মিশেল তাহলে তো সেখান থেকে ভালো কিছু পাওয়ার থাকবে না।
আমরা কি বলতে পারিনা যে আমাদের শিশুরা সবচাইতে বেশি অবহেলিত হচ্ছে?
তা তো অবশ্যই। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, আমাদের সামাজিক বা পারিবারিক চিন্তা চেতনাও এর জন্য দায়ী। একটা সময় ছিল যখন একটা পরিবারের সৌন্দর্য্য নির্ভর করতো সে পরিবার কতটা মার্জিত রুচিশীল, সে পরিবারের ছেলেমেয়েরা কতটা মেধা মননের চর্চা, খেলাধুলা বা সংস্কৃতি চর্চা করছে এসবের উপর। কিন্তু বর্তমানে এসবের বদলে সৌন্ধর্য্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে ঘরে কত বড় আয়তনের এলসিডি বা এলইডি টিভি রয়েছে, কোন মডেলের গাড়ি রয়েছে, কেমন ফার্ণিচার রয়েছে, মেয়ের জন্য গোলাপী আর ছেলের জন্য নীল ঘর ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো অনেক কিছু। অর্থাৎ আমরা এখন ভোগবাদের দুনিয়াতে চলে গেছি। যার ফলে আরেকটি ক্ষতি হচ্ছে, আমাদের জীবন যাপনে খরচের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। যে খরচ মেটানো অনেক সময়ই বৈধ আয়ে সম্ভব হচ্ছেনা। যার ফলে সমাজে অবৈধ উপার্জনের প্রবণতা বাড়ছে।
এর থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ নেই?
আমাদের এখন প্রয়োজন সমাজ সংস্কারের, এবং তার জন্য প্রয়োজন সংস্কারক। আমরা আমাদের মূল যে সম্পদ অর্থাৎ মানব সম্পদ, তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না। আমাদের সমাজ নিয়ে গবেষণা নেই, কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই, সমাজবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ নেই।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। রাগ হয়?
হ্যাঁ, ভীষণ রাগ হয়।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন কিভাবে?
রাগটা প্রকাশ করে ফেলি। নিয়ন্ত্রণ করি না।
মন খারাপ হয়?
হয়, এবং সেখানেও আমি মন খারাপটা প্রকাশ করে ফেলি।
আরেকবার জীবন শুরুর সুযোগ পেলে কি হতে চাইতেন?
এখন যা আছি সেটাই আবার হতে চাইতাম। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো সামান্য পরিবর্তন চাইতাম। তবে সব মিলিয়ে যা আছি সেটাই হতে চাইতাম।
স্বপ্ন দেখেন?
স্বপ্ন তো দেখিই। স্বপ্নই তো সব থেকে বড় শক্তি। অহরহ স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি বাচ্চাদের একটা স্কুল হবে যেখানে বাচ্চারা রোজ সকালে গাইবে, ‘মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ। জয় জয় সত্যের জয়।’ স্বপ্ন দেখি চলচ্চিত্র/টিভি একাডেমির অর্থাৎ যে মাধ্যমে আমি কাজ করি সেখানে অনেক আলোকিত অনেক শিক্ষিত মানুষেরা কাজ করবেন। যেখানে সাব স্ট্যান্ডার্ড বলে কোনো শব্দ থাকবে না। স্বপ্ন দেখি পৃথিবীতে আর সন্ত্রাস নেই, মানুষ অনেক সুন্দরভাবে জীবন যাপন করছে, স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের সকল মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো চলে এসেছে।
স্বপ্নগুলো কেমন?
স্বপ্ন দেখি বাচ্চাদের একটা স্কুল হবে যেখানে বাচ্চারা রোজ সকালে গাইবে, ‘মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ। জয় জয় সত্যের জয়।’ স্বপ্ন দেখি চলচ্চিত্র/টিভি একাডেমির অর্থাৎ যে মাধ্যমে আমি কাজ করি সেখানে অনেক আলোকিত অনেক শিক্ষিত মানুষেরা কাজ করবেন। যেখানে সাব স্ট্যান্ডার্ড বলে কোনো শব্দ থাকবে না। স্বপ্ন দেখি পৃথিবীতে আর সন্ত্রাস নেই, মানুষ অনেক সুন্দরভাবে জীবন যাপন করছে, স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের সকল মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো চলে এসেছে।
আপনার দেখা টেলিভিশনের সেকাল ও একালের মধ্যে পার্থক্য কি?
আগে টেলিভিশন ছিল দর্শকদের সুন্দর ও সুস্থ বিনোদন দেয়ার জন্য। যা থেকে দর্শক সুন্দরভাবে বিনোদিত হয়েছেন, শিখেছেনও অনেক কিছু। আর এখন এত এত টিভি চ্যানেল, টেলিভিশনের মালিকরা কেন চ্যানেল চালাচ্ছেন এবং কি চাইছেন, ব্যবসা ছাড়া অন্যকিছু চাইছেন কি? যত অনুষ্ঠান হয় তার একশো ভাগের বিশ ভাগের হয়তো কিছু মান আছে এবং বাকী সব অত্যন্ত মানহীন।
মনেরখবর পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি?
যারা এই লেখাটি পড়ছেন তাদেরকে বলবো, আমাদের সবাইকে মিলে সমাজটাকে সংস্কার করতে হবে। এবং এটাই আমাদের সবচাইতে উপযুক্ত সময়। এ সংস্কারের জন্য তেমন বড় কিছু করার প্রয়োজন নেই, আমরা যদি শুধু আমাদের পাশের মানুষটার দিকে তাকাই, আমি যদি আমার পরিবারের কথা ভাবি, আমার কর্মস্থলের কথা ভাবি তাহলেই একসময় ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক পর্যায়ে আমরা সকলে মিলে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের হয়ে আসতে পারবো।
মনেরখবরে সময় দেয়ার জন্য পাঠকদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
ধন্যবাদ মনেরখবর পাঠকদেরও। এবং আবারো বলি, আসুন আমরা সবাই মিলে অন্ধকারে ধাবমান সমাজকে আলোর পথে নিয়ে আসি। স্বচ্ছতা, শুদ্ধতা ও সত্যের চর্চা করি।