পর্ব ১:
দাবা খেলায় মগ্ন হয়ে আছে দুই ভাই বোন সোমা আর দীপ্ত। দীপ্তর রাজা আছে বিপজ্জনক অবস্থায়। বোনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে দীপ্ত। সোমা বেশ মজা পাচ্ছে, আর একটা চাল দেবে দীপ্ত। সোমার জানা আছে কোন চাল দেবে ভাই, তারপরই ভাই এর রাজাকে সে নিজের মন্ত্রী আর ঘোড়া দিয়ে আটকে দেবে, কিস্তিমাত হয়ে যাবে। দীপ্ত চালটা দিতেই সোমার মুখে খুশি ফুটে উঠলো।
শিকারকে কোনঠাসা করে খুশি ফুটে উঠতো প্রায় পঁচিশ লাখ বছর আগের প্লাইস্টোসিন যুগের মানুষেরও। দাবা খেলায় এই যে প্রতিপক্ষের রাজাকে কোনঠাসা করে জিতে যাওয়ার আনন্দ তা শিকারী পূর্বসুরি মস্তিষ্কের গঠনের বহিঃপ্রকাশ কিনা তা গবেষনার বিষয়।
আক্রমনাত্মক বা আগ্রাসী মনোভাব বা আচরণ আধুনিক সমাজে সাধারণভাবে গৃহীত নয় বলেই আমরা ধরে নেই। কিন্তু ফুটবলের মাঠ, ক্রিকেট, রাগবি, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি প্রভৃতি খেলায় এবং খেলা দেখার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আমরা আগ্রাসী মনোভাব এবং আচরণকে কিছুটা নির্লিপ্ত ভাবেই মেনে নিই।
এই পর্যন্ত এসে পাঠকের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে। ফুটবলে প্রিয় দলের খেলোয়ার জয়ের জন্য বিরুদ্ধ দলের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে যেমন করেই হোক বল নিজের পায়ে রেখেছে – এখানে কোথায় আগ্রাসন, আর সেটাতে কিই বা যায় আসে?
বিষয়টা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষের আগ্রাসী মনোভাবকে খেলাধুলার মাধ্যমে একটা কাঠামোবদ্ধভাবে প্রকাশ করা যায় কি না, খেলাধুলায় জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে আগ্রাসী মনোভাব কতটা ভুমিকাই বা রাখে, কতটুকু মাত্রার আগ্রাসন খেলাধুলায় আমরা মেনে নিতে পারি, আর খেলাধুলায় যে আগ্রাসনের প্রদর্শন হচ্ছে তা আমাদের দৈনন্দিন আচরণকেই বা কতটা প্রভাবিত করতে পারে।
আগ্রাসনের সাথে ক্রীড়ার সম্পর্ক নিয়ে বলার সুবিধার্থে আগে আগ্রাসন কি ভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে তা দেখি। ‘যে কোনো ধরনের আচরণ যেটা অপরের ক্ষতির উদ্দেশ্যে করা হয় তাই আগ্রাসন-ক্ষতি মানসিক অথবা শারীরিক বা উভয়রকমই হতে পারে।’
উদ্দেশ্য অনুযায়ী খেলাধুলায় আগ্রাসন হতে পারে দুই রকমেরঃ বিদ্বেষপূর্ণ আগ্রাসন (Hostile aggression)এবং যান্ত্রিক বা সহায়ক আগ্রাসন (Instrumental aggression)। যেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরকে আঘাত করা বা তার ক্ষতি করা সেটা হচ্ছে বিদ্বেষপূর্ন আগ্রাসন, যেমন মুষ্টিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের কান কামড়ে ছিড়ে দেয়া। আর যেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিপক্ষ হতে খেলায় এগিয়ে যাওয়া সেটা হচ্ছে যান্ত্রিক বা সহায়ক আগ্রাসন, যেমন পেশাদার ভাবে ফুটবলে ট্যাকল করে বল নিজের পায়ে নেয়া।
কোনো আগ্রাসনের গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে একে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়- অনুমোদিত আগ্রাসন এবং অননুমোদিত আগ্রাসন। এই ব্যাপারে খেলার ধরন অনুযায়ী পার্থক্য আছে। যেমন ফুটবলে গোল এড়াতে পেশাদার ফাউল অনুমোদিত আগ্রাসন, কিন্তু ফাউলের ধরন অনুযায়ী খেলোয়াড়কে রেফারি সতর্ক করে দিবেন অথবা হলুদ-লাল কার্ড দেখানোর বিষয়টা ঠিক করবেন। লাল কার্ড যেখানে দেখানো হচ্ছে সেটা অননুমোদিত আগ্রাসন সেটা উদ্দেশ্য বিচারে সহায়ক হলেও।
এই প্রকারভেদগুলো নিয়ে আবার সরাসরি আঘাতমূলক খেলার ক্ষেত্রে মতভেদ আছে। মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি, রাগবি এসব খেলায় প্রতিপক্ষকে হারাতে গেলে কিছু না কিছু আঘাত করতেই হবে। সেসব ক্ষেত্রে সহায়ক আগ্রাসনও অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি যোগ্য যদি আক্রান্তের বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতির আশংকা থাকে। যেমন মুষ্টিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের মাথা নিজের মাথা দিয়ে ঠুকে দেয়াটা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে হলেও সেটা অনুমোদিত, কারণ ধরা হয় সেটা মুষ্টিযোদ্ধার জমতে থাকা চাপের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধে প্রতিপক্ষের ঘাড় অথবা কুঁচকিতে আঘাত পরিষ্কার ভাবেই ক্ষতিকর এবং অননুমোদিত।
খেলাধুলার নৈপুন্যের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক বা সহায়ক আগ্রাসন খেলাধুলায় উপকারী কিন্তু বিদ্বেষমূলক আগ্রাসন ক্ষতিকর।
খেলাধুলায় আসলে কোন আগ্রাসনটাকে মেনে নেয়া হবে এটা বোঝার জন্য এই শ্রেনীবিভাগটা প্রয়োজন। আর কী ভাবে বিদ্বেষমূলক আগ্রাসন কমানো যায় সেটা বের করতে হলে তা আলাদা করা প্রয়োজন। খেলায় জয়ের জন্য প্রতিপক্ষকে কতটুকু আঘাত করতে পারবে তার সীমারেখা নির্দিষ্ট করাটাও প্রয়োজন।
পরবর্তী পর্বে খেলায় আগ্রাসনের উৎস এবং খেলা আগ্রাসন বৃদ্ধি করে না কমায় তা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।