ডা পঞ্চানন আচার্য্য
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
মানুষ সামাজিক প্রাণী হলেও বেঁচে থাকার সংগ্রামে সবার সাথে তার সমান গভীর সম্পর্ক হয় না। কোটি কোটি মানুষের মধ্যেই হাতেগোনা কিছু মানুষ হয়ে উঠেন একজন মানুষের সুখ—দুঃখের সাথী, বিপদের ভরসা, নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যাদের সাথে মন খুলে সব বলা যায়, নিজের ভালো এবং মন্দ নিয়েও যাদের কাছ থেকে আশা করা যায়Ñনিজেদের ভালো—খারাপ যাই লাগুক শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবে। অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকুক, অন্যভাবে ভাবুকÑতারপরেও বন্ধুর মতো পাশে পাওয়া যাবে এই মানুষগুলোকে।
এরকমই মানুষগুলোকে বলা হয় কারো নিকটজন। এরা এমনই কিছু ব্যক্তি যারা একজনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আবেগীয়, সম্পর্কীয়, বা সামাজিক গুরুত্ব ধারণ করেন। এই সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য হলো গভীর ব্যক্তিগত সংযোগ, পারস্পরিক বিশ্বাস, এবং অর্থপূর্ণ যোগাযোগ। এরা হতে পারেন পরিবারের সদস্য, যেমন বাবা—মা, ভাই—বোন, সন্তান; অথবা হতে পারেন বন্ধু, জীবনসঙ্গী, ব্যক্তিগত জীবনে যেকোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখেন এমন ব্যক্তিরা।
যেহেতু এই নিকটজনেরা আবেগিক দিক থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকেন, তাই এরকম একজন কাছের ব্যক্তিকে হারানোর প্রভাব অত্যন্ত গভীর হয়ে থাকে। এই বিষয়টিকে কীভাবে সামাল দেয়া হচ্ছে তার উপর কিন্তু ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে বলতে গেলে পুরো জীবনটাই নির্ভর করে। যেকোনো অপ্রত্যাশিত মানসিক চাপ বা আঘাত আসলে একজন মানুষ একটা সাধারণ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যান। এই প্রক্রিয়ায় ৫টি ধাপ রয়েছে। এক নজরে সেগুলো দেখে নেয়া যাক-
১ম ধাপ/ অস্বীকৃতি : যেকোনো একটা দুঃসংবাদ অথবা অপ্রত্যাশিত চাপের মুখোমুখি হলে সেটি প্রথমেই মেনে নেয়ার পরিবর্তে একটা অস্বীকার করার ধাপটি আসে। এক্ষেত্রে, মানুষটির মনে হয় যে না এটা আসলে সত্যি নয়, এই তো কিছুক্ষণ পরেই শুনব যে সব ঠিক আছে, এখনো একটু আশা আছে, অথবা এটা হতেই পারে না। যেমনÑনিকটজনের কেউ আকস্মিক মারা গেলে মনে হতে পারে এটি সত্য নয়।
২য় ধাপ/ ক্রোধ : বাস্তবতা যখন একসময় বোধের মধ্যে আসে, যখন মানুষ বুঝতেই পারে যে আসলেই আমার নিকটাত্মীয় মারা গেছেনÑতখন ভিতরে একধরনের ক্রোধ তৈরি হয় বা হতে পারে। এই সত্যকে গুঁড়িয়ে দিয়ে চাওয়া মতো ফলাফল নিয়ে আসতে ইচ্ছে হয়, এবং সেটা সম্ভব না জেনে আরো নিস্ফল আক্রোশ দলা পাকাতে থাকে মনের ভিতর।
৩য় ধাপ/ তর্ক : রাগ একটু কমে আসলে তখন মানুষজন বিভিন্ন ধরণের তর্ক বা বিচার—বিশ্লেষণে যেতে থাকে। সেটা হতে পারে অন্যের কার্যকলাপের সমালোচনা, যেমন চিকিৎসক মনে হয় ঠিকভাবে চিকিৎসা করেননি, এই বিষয়টা হয়ত উনারা খেয়াল না করাতে আমার নিকটজন মারা গেছেন। অথবা হতে পারে নিজের কার্যকলাপের বিশ্লেষণ। যেমন ইস! আমি যদি এই কাজটা না করতাম, আমি যদি আরেকটু আগে এটা বুঝতে পারতাম।
৪র্থ ধাপ/ বিষণ্ণতা : বিচার—বিশ্লেষণ শেষে ভর করে বিষণ্ণতা। মানুষ বুঝতে পারে আমার আপনজন আর ফিরে আসবেন না। তাঁকে আসলেই হারিয়ে ফেললাম। আর দেখতে পাব না। তবে তখনো পুরোপুরি মন থেকে মেনে নেয়ার বিষয়টি কিছুটা দূরেই থাকে।
৫ম ধাপ/ মেনে নেয়া: অবশেষে, মানুষ ক্ষতির বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করে। তারা মন থেকেই মেনে নিতে শুরু করেন যে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এরপর নতুন বাস্তবতায় নতুন করে অভিযোজনের চেষ্টাও সাধারণত শুরু করেন।
খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, এই ধাপগুলো সবার ক্ষেত্রেই যে একটার পর একটা আসবে সবসময় তেমনটি নয়। একেক মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া একেকরকম হতে পারে, যেকোনো একটা ধাপ দিয়েই শুরু হতে পারে, আবার ধাপগুলো পিছনের দিকেও যেতে পারে। আর এখানেই নিহিত থাকে নিকটজনের আকস্মিক মৃত্যুতে একজনের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে যাবে নাকি অস্বাভাবিক কোনো ফাঁদে আটকে পরে মানসিক জটিলতা তৈরি হবে।
যদি স্বাভাবিকভাবে এর সমাপ্তি না ঘটে তবে, শোকের তীব্রতা বা সময়কাল অস্বাভাবিকভাবে বেশি হতে পারে। এর মধ্যে গভীর দুঃখ, রাগ, অপরাধবোধ, বা অনুশোচনা অন্তভুর্ক্ত থাকতে পারে। হঠাৎ হারানোর ফলে মেজাজের ওঠানামা এবং আবেগগত অস্থিতিশীলতা ঘটতে পারে। মানুষ প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে কাঁদতে পারে, অযৌক্তিকভাবে রাগ অনুভব করতে পারে, অথবা মাথাব্যথা, পেটব্যথা, বা প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করতে পারে। মানসিক কর্মক্ষমতার হ্রাস ঘটতে পারে, কারণ এ সময় মনোযোগের অভাব হতে পারে, এবং বিভ্রান্তি বা ভুলে যাওয়ার অনুভূতি থাকতে পারে।
তৈরি হতে পারে নিজের অস্তিত্ব সংকটের মত বিষয়। কারণ, মানুষের মনে জন্ম নিতে পারে জীবনের অর্থ, নিজের মৃত্যুবোধ, এবং অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন। সব মিলিয়ে মানুষটি সামাজিকভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে। হারানোর যন্ত্রণা মোকাবেলা করার একটি উপায় হিসেবে মানুষ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে পিছিয়ে যেতে পারে বা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, শোক এত জটিল বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে যে তা মানুষের বেঁচে থাকা বা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়াকেও থামিয়ে দিতে পারে। এমন সময়ে তাই বন্ধু, পরিবার, বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের সহায়তা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে শোক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
একেক জনের ক্ষেত্রে এর মাত্রা বা ধরন একেক রকম হতে পারে। তাই এটা মোকাবেলা করার প্রক্রিয়াও একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই সময়ে সবার সহমর্মিতা, সহায়তামূলক মনোভাব নিকটজন হারানো মানুষটাকে স্বাভাবিক হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।