যখন কোনো অভিভাবক বুঝতে পারেন তাদের সন্তানটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে, সমাজের আর দশটা বাচ্চার মতো কথিত স্বাভাবিক নয়, তখন অনেকেই মুষড়ে পড়েন, মেনে নিতে পারেন না, স্বীকার করতে চান না। অনেকেই ব্যাপারটিকে লজ্জাস্কর বলে ভাবেন।
কিন্তু সকলেই তা করেন না। জীবনব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সন্তানকে আঁকড়ে ধরেন অনেকে, পরাজয়কে তারা অস্বীকার করেন। সন্তান অন্যের চোখে চমক লাগিয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে এমন আকাঙ্খায় নয়, তারা সন্তানকে শিখিয়ে দিতে চান পৃথিবীতে বসবাসের কায়দা-কানুন। যাতে তারা টিকে থাকার যুদ্ধে জিতে যায়।
এমনই একজন মা শেখ তাসলিমা মুন। সন্তানের জন্য যুদ্ধটা যিনি একাই লড়েছেন এবং লড়ে যাচ্ছেন। সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাগুলো তিনি জানিয়েছেন মনের খবরকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিকা রুমন।
আপনার সন্তানের বয়স কত?
আমার ছেলের বয়স এখন ২০।
প্রথম কবে জানতে পারলেন আপনার বাচ্চা আর দশটা বাচ্চা থেকে আলাদা?
ওর তিন বছর বয়সে প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে তিন বছর কন্ট্রোল বলে একটি কন্ট্রোল থাকে। তখন তাকে বিভিন্ন খেলা দেওয়া হয়। যেমন- কোনটা কোন কালার। কমান্ড নিতে পারছে কিনা। ইন্সট্রাকশন নিতে পারছে কিনা। সেগুলোতে ধরা পড়ে ও ওগুলোতে আগ্রহী না। নিজের মনে নিজের খেলা খেলতে আগ্রহী।
সেটা নিশ্চয়ই একটা ধাক্কা ছিল? কাটিয়ে উঠলেন কীভাবে? তারপর এতটা পথ কীভাবে এলেন?
ধাক্কা ছিল অবশ্যই। তখন আমি একটি নতুন জবে জয়েন করেছি। খুব ফোকাসড জবে। এটা বুঝেই উঠতে পারিনি প্রথম। মানতেও পারিনি। মনে আছে বড়ো ধরনের ঝগড়া করে ফেললাম ওদের সাথে। জোর গলায় বললাম, আমার ছেলের কিছু হয়নি, এগুলো তোমাদের বাড়াবাড়ি। ওরা আমাকে অনেক হেল্প করেছিল তখন। পুরো ছয়টা মাস লেগেছিল বিভিন্ন সিটিং, পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। জীবনের ডিজাইনটা বদলে নিতে হয়েছিল এবং হয়েছে।
সন্তানকে নিয়ে এই যুদ্ধটা করতে গিয়ে সামাজিক কোনো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে কি?
কীভাবে সে পথ পাড়ি দিলাম সেটা সংক্ষেপে বলা সম্ভব নয়। আমি সিঙ্গেল প্যারেন্টও। অটিজম অজ্ঞ প্যারেন্ট হিসেবে আমার যুদ্ধটা হয়েছিল তখন পর্বত বয়ে নিয়ে যাত্রার মতো। কিন্তু আমি মনে করেছি, অভিভাবক হলো শিশুর নিজের পৃথিবী বুঝে পাবার একটি বিদ্যালয়। আমার বাচ্চা বিশেষ অ্যাবিলিটির হোক বা বেশির ভাগের মতো হোক, আমিই মাধ্যম তার জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠার।
আমাকে শিখতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে। আমি সেটাকে অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে নেই। এখানে বেশির ভাগ মানুষ খুব ভালো আচরণের অধিকারী। তবুও অজ্ঞতার পরিমাণ ২০ বছর আগে একটু ছিল।
আমার ছেলে প্রচণ্ড রেস্টলেস তখন, তাদের ধারণা হতো, আমি অজ্ঞ প্যারেন্ট, ছেলেকে আদব-কায়দা শেখাতে পারিনি। কারণ বাহ্যিক চেহারায় সে সবার মতো। আমাকে অনেক ট্রেইনিংয়ে যেতে হয়েছে। নিজের ছেলেকে এবং পারিপার্শ্বিক মানুষকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি সে বিষয়ে আমি প্রশিক্ষণ নিই।
সামাজিক প্রতিকূলতাগুলো কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি?
বাংলাদেশে এ বিষয়ে যে অবস্থা তা ভয়াবহ। আমি সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতাও রাখি না। অনেক প্যারেন্টই নিজেদের বাচ্চাদের শত্রু। আমি এমনভাবে মারতে দেখেছি বাচ্চাগুলোকে যে মাসের পর মাস আমি ঘুমুতে পারিনি।
আর সামাজিক অবস্থার কথা না বলি। এমনকি রাষ্ট্রীয় কোনো সহযোগিতা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ অটিজম নামটি শুনেছে বটে কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ সকল প্রতিবন্ধকতার নাম অটিজম দিয়ে ফেলেছে। এমনকি ডাউন্স সিন্ড্রোম বাচ্চাদেরও অটিস্টিক বলা হয়ে থাকে দেখলাম।
হুইল চেয়ারে বসা বাচ্চাকেও দেখলাম বলছে অটিস্টিক। অর্থাৎ যেকোনো ডিজঅ্যাবিলিটির নাম বাংলাদেশে অটিজম। এ থেকে বোঝা যায়, অটিজম বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় ধারণার অভাব রয়েছে।
আমার বাচ্চার ভাগ্য ভালো যে তার জন্ম একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে। এখানে সে স্পেশ্যাল স্কুলে যায় যাকে বলে ট্রেইনিং স্কুল। সেখানে তাদের অ্যাবিলিটি ট্রেইংসহ বিনোদনমূলক সকল কর্মকাণ্ড রয়েছে। সুইমিং, মুভি, থিয়েটার, স্পোর্টস, মিউজিক সবকিছুতে তারা অংশগ্রহণ করে এবং তার জন্য আমাকে একটি পয়সাও ব্যয় করতে হয় না। স্কুলে ওর জন্য রয়েছে একজন শিক্ষক এবং একজন সহকারী শিক্ষক।
নিশ্চয়ই বেশির ভাগ মায়েদের চেয়ে আপনাকে মানসিক চাপ নিতে হয়েছে বেশি, মনের জোর ধরে রেখেছেন কীভাবে?
আমার যুদ্ধটা দীর্ঘ। ২০ বছরের যুদ্ধ বলব নাÑবলব এই সময়টা আমার জীবন-আনন্দ, আমার অনুপ্রেরণা। এ পর্বটি আমাকে একজন উন্নত মানুষে পরিণত করেছে।
নিজেকে ভালো রাখার জন্য কী করেছেন বা করেন?
আমার বাচ্চার এক্সিস্টেন্সকে সম্মান করি। আমি যদি তার বিশেষ অবস্থার জন্য কান্নাকাটি করি, তার মানে তাকে আমি তার মতো করে সম্মান করতে পারছি না। অন্য কোনো বা কারও মডেলে তাকে দেখে আমি তাকে অসম্মান করছি।
প্যারেন্ট হিসেবে আমার দেখার বিষয় আমার সন্তান সুখী কিনা। ওকে সুখী করাই আমার কাজ। প্রতিটি শিশুর মতো তার শেখার ক্ষমতা আছে, তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। আমার কাজ, তাকে সেখানে সহযোগিতা করা।
আমার কাজ তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রেখে যাওয়া যাতে আমি যেভাবে করছি সেটা আমার অবর্তমানে অন্য কেউ করতে পারে।
কোনো মা–বাবা যখন বুঝতে পারেন তাদের বাচ্চা স্বাভাবিক নয়, তখন অনেকেই ভেঙে পড়েন, মেনে নিতে পারে নাÑতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে আপনার?
আমি যেহেতু পৃথিবীর কোনো বিয়িংকে দুর্বল বা কমজোর মনে করি না, আমার বাচ্চাকে সেভাবে দেখার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সবার ডাক্তার হতে হবে, প্রফেসর হতে হবে কে বলল! ও ওর মতো এ পৃথিবীর সুখ গ্রহণ করবে। উপভোগ করবে জীবন এবং আমাকে তা তৈরি করতে হবে এটাই আমার প্যারেন্টাল জব।
আমরা কেউ সো কল্ড নর্মাল নই। আমরা সবাই সবার মতো আলাদা। ইউনিক। আমার বাচ্চাও ইউনিক। সে আমাদের মতো নয়, আমরাও তার মতো নই। আমাদের এতটুকু হাম্বল হতে হবে যে, ওদের মতো হতে হবে, ওদের মতো হয়ে ওদের বুঝতে হবে। তবেই ওদের জীবন সহজ করতে পারব।
ওদের জন্য যতবার পিটি ফিল করবেন, নিজের সন্তানকে অসম্মান করলেন। সেটাই হবে বড়ো ট্রাজেডি। ওকে শ্রদ্ধা করুন। তাকে জানার চেষ্টা করুন।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বাচ্চাদের একটি নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বা মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। প্রতি বছর ২ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। সাধারণত ২-৩ বছর বয়সের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়।
সোশ্যাল কমিউনিকেশন এবং ইন্টারেকশন অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেইসঙ্গে একই ধরনের আচরণ, কাজ এবং একই ধরনের জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়।
এই রোগ পুরোপুরি নির্মূলের জন্য কোনো চিকিৎসা না থাকলেও নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়। যদি চিকিৎসা অল্প বয়সে শুরু করা যায়, তাহলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগের লক্ষণগুলো কমিয়ে শিশুর কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং তার সামাজিক বিকাশে সাহায্য করা। বাসায় চিকিৎসার পাশাপাশি স্কুলেও কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্তমানে অটিজমের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের থেরাপি দেয়া হয় যেমন- ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি, বিহেভিয়ার ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনিং, জয়েন্ট অ্যাটেনশান থেরাপি, সেন্সরি ইন্টিগ্রেশান থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, ফিজিক্যাল থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং রিলেশনশিপ ডেভেলপমেন্ট ইন্টারভেনশান ইত্যাদি।
যদিও ওষুধের মাধ্যমে অটিজমের বাচ্চাদের মূল সমস্যাগুলো সমাধান করা যায় না, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ওষুধের মাধ্যমে রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অটিজমের সঙ্গে যদি অন্য কোনো বিকাশজনিত, আচরণগত ও উদ্বিগ্নতাজনিত সমস্যা থাকে তখন অ্যান্টিসাইকোটিক এবং অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে।
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে যে মেমান্টিন ওষুধটি ভাষা ও সামাজিক দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করে এবং ডিসাইক্লোসেরিন ওষুধটি ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক উদ্বিগ্নতা (সোশ্যাল অ্যাংজাইটি) কমে ও সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ে।
অটিজমের বাচ্চাদের অভিভাবকদের তাই আতঙ্কিত অথবা উদ্বিগ্ন না হয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা ও থেরাপি নিলে রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং শিশুর মানসিক বিকাশ ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে