ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বে পরার্থপরতা

0
8
ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বে পরার্থপরতা

দেবদুলাল রায়

রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

পরার্থপরতা, যার ইংরেজী প্রতিশব্দ Altruism ল্যাটিন শব্দ Altur থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ অপর-বাদিতা। উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে ফরাসী সমাজ বিজ্ঞানী কষ্ট স্বার্থপরতার বিপরীতার্থক ধারণা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানে পরার্থপরতার ধারণাটি আনেন। কষ্টের মতানুযায়ী মানুষের জীবনে দুটি স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে, একটি অহংবোধ অন্যটি পরার্থপরতা। পরবর্তীতে সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ভারীখম কষ্টের পরার্থপরতার ধারণা নিয়ে বিশদ কাজ করে গেছেন। ১৮৯৩ মাসের একটি সভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, পরার্থপরতা এবং অহংবোধ প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মধ্যে সমান্তরাল ভাবে বিদ্যমান। কারণ মানুষের নিজেকে এগিয়ে নিতে স্বার্থপরতার প্রয়োজন হয়, আবার গোষ্ঠীতে বসবাস করতে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা মহযোগীতার প্রয়োজন ‘হয়।

পরার্থপরতা মূলত একটি মানবিক অনুভূতি। বিভিন্ন মানবিক গুনের সমন্বয়ে এই অনুভূতি প্রমারতা লাভ করে। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে আশা, সামাজিক সম্পার্কে ভরসা, জীবনের প্রতি ‘সমাদর, কৃতজ্ঞতাবোধ, আত্মমর্যাদা, অন্যের কাছে মূল্যবান হবার অনুভূতি, অন্যদের প্রতি সমানুভূতি, অন্যদের সাহায্য করার অনুপ্রেরণা, সাধারণভাবে শক্তি এবং উৎসাহ এবং ধার্মিক বিশ্বাস। এই সকল গুণাকর্মীর সমন্বয়ে পরার্থপরতা সমৃদ্ধ হয়। এই সকল গুণাবলীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পরার্থপরতার ভিত্তি মূলত ভালোবাসা, ভালবেসে অব অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করে তাকে সাহায্য করা, অন্যের অবদান ভালোবাসার সাথে স্মরণ করা।Magazine site ads

অন্য একজন মানুষ ও আমার মতই রক্তে মাংমে পড়া মানুষ, আমার মতই সেও সুসংবাদে আনন্দিত হয়, কষ্টের জ খবরে ব্যথিত হয়, আমার মত তারও ইচ্ছে করে প্রাণখুলে বাঁচবে এই কথাগুলো যখন মনের ভিতর থেকে উপলবিদ্ধ করা যায় তখনই অন্য মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ চলে আসে। এই তাগিদ যখন আসে তখন মানুষ যাচ্ছে স্বার্থ-লাভ-ক্ষতির হিসেব ভুলে একাগ্রচিত্তে মানুষের উপকারের সাধনায় ব্রতী হয়। বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ভালোবামা ভীষণ রকম ছোঁয়াচে।

কেউ একজন ভালোবামার প্রকাশ ঘটাসে তা তড়িৎ বেচা অন্যদের ও আন্দোলিত করে। তখন পরোপকারী মেই ব্যক্তির আশেপাশের মানুষও অন্যের উপকার করতে উদ্বাহু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে সংঘটিত বন্যার সময়কার চিত্র পর্যালোচনা করলে আমরা পরার্থপরতার উজ্জ্বল নিদর্শন দেখতে পাই। দেশের এক প্রান্ত হঠাৎ বন্যায় ডুবে যাওয়ায় সমগ্র দেশের মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত ত্রাণ সংগ্রহ কার্যে মানুষের ঢল নামে।

মানুষ যে যা পারে। তাই নিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ওষ্টা করে। ব্রাণদাতাদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই কেউ কেউ মাটির ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ ত্রাণকার্যের জন্য তুলে দিচ্ছেন, কোনো এক গৃহবধূ অর ব্যবহার্য কানের দুল তুলে দিচ্ছেন। যাদের জন্য এই দান তাদের কাউকেই দেখেন নি, কিনেন না। তবুও একই দেশের মানুষের বিপদে প্রাণ কেঁদে ওঠায় এই তমা।মনের খবর ম্যগাজিনে

কিন্তু কষ্টের ধারণা অনুযায়ী স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা একই মাথে মানুষের মধ্যে বহমান। আনুষের বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই নিজ স্বার্থ দেখতে। স্বার্থের জন্যই মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটে চলে। স্বার্থ আছে বলেই দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে। স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষিত হলে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়বে। মানুষ নতুন কিছু করার উদ্যম অনুভব করবে না। বর্তমান বিশ্ব প্রতিযোগিতার বিশ্ব। এখানে স্বার্থ ছাড়া টিকে থাকা দুষ্কর। আগে চাহিদাগুলো ছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমার পরে চাহিদাগুলো হয়ে গেছে সামাজিক। অন্যের দেখাদেখি অভাব বাড়ছে। বাড়ছে মুখের প্রতিযোগিতাও।

এই অমীম প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে বাড়ছে মানুষের স্বার্থান্ধতা। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি মানুষই তার স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু এই স্বার্য যখন অন্ধত্বের ররূপ পরিগ্রহ করে, শুধুমাত্র নিজের লাভ ক্ষতির হিসেবটাই কষতে মেখে, অন্যের সুবিধা অসুবিধা কে অগ্রাহ্য করে শুধু নিজের ভালোটাই দেখতে থাকে, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের অধিকার হরণ করতে পিছপা হয় না, তখন তা স্বার্থপরতার রাপ লাভ করে। একজন স্বার্থপর ব্যক্তির সকল চিন্তা আত্মকেন্দ্রিকা তার চিন্তা-ভাবনা নিজের লাভ কে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। যে বৃত্তজুড়ে থাকে কুৎসিত আমিত্ব।

অন্যের মুখোন সুবিধার কথা ভাববার অবকাশ তার হয় না। অন্যের দুঃখকষ্টও তাকে স্পর্শ করে না। স্বার্থপর ব্যক্তি দিনরাত নিজেকে নিয়েই মন্ত্র থাকে। নিজ প্রয়োজনে একের পর এক ধাপ অতিক্রম করতে থাকে। এভাবে উঠতে উঠতে একসময় আবিষ্কার করে আদতে সে একা। যেহেতু অন্যের আনন্দ বেদনা তাকে কখন ও সস্পর্শ করেনি, তাই একা বাঁচতে বাঁচতে একসময় তার কাছে জীবন অর্থহীন মনে হয়।

অন্যের সুখে সুখী হতে না পারক, অন্যের বেদনায় বেদনার্ত না হতে পারার কারনে সবার সাথে জীবনের আনন্দ ভাগ করার মুকেশ বয়স একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একই মাথে তার জীবন এবং সমাজ-কে প্রভাবিত করে। মানুষের অভিজ্ঞতা যত গভীর হয় তার প্রভাব উপযুক্ত দশটি গুণের উপর পড়ে।

অভিজ্ঞতার সাথে সাথে মানুষ অন্য মানুষের উপর আশাবাদী হয়, সমাজ ধামার্কে আশাবাদী হয়। সমাজের সকল মানুষের মাথে একাত্মতার বোধ সৃষ্টির মাথে সমানুভূতির মাধ্যমে সবার দুঃখ কষ্ট বুঝতে শেখে। এভাবে পরার্থপরতার ধারায় আত্মতুষ্টি লাভ করে। মানবিকতার প্রতি বিদ্রূপম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে দয়াময় দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে

যদিও মানুষের মধ্যে একই মাথে দুটি বিপরীত অনুভূতি স্বার্থপরতা এবং পরার্থপরতা বহমান- এবং জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে প্রতিটি মানুষকে স্বার্থন হাবেতন থাকতে হয়, তবুও জীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য পরার্থপরতার ধারাটি ও প্রবাহমান রাখতে হবে। পরার্থপরতার ধারাটি যথাযথ ভাবে প্রবাহমান রাখলে যেমন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মুবিকাশ ঘটবে। সেই সাথে সমাজেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যে প্রভাবে আরেকজন অসহায় মানুষ হযতো নতুন করে বাঁচার সম্পৃহা পাবে!

আরও পড়ুন-

Previous articleবিএপি আয়োজিত শীতকালীন ইনডোর গেমস প্রতিযোগিতা ৪-৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here