নির্যাতনের শিকার হতে পারেন স্বামী ব্যক্তিটিও

নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রাচুর্যতায় আমরা হয়তো লক্ষ্যই করিনা যে সমাজে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসই করিনা যে পুরুষ বা স্বামী ব্যক্তিটিও নির্যাতনের শিকার হতে পারে। পুরুষশাসিত সমাজ, নারী অধিকার রক্ষা ও সচেতনতা এবং অতি মাত্রায় নারী নির্যাতন প্রভৃতি কারণেই হয়তো পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টিতে আমরা উদাসীন।

husband abuse

আমাদের সমাজে এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা নমনীয়, অভদ্র বা অসভ্য আচরণ করেন না, হিংস্র ব্যবহার করেন না। স্ত্রীর প্রতি দুর্বলতার কারণেই হোক, সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েই হোক কিংবা সংসার রক্ষার তাগিদেই হোক মুখ বুজে স্ত্রীর নির্যাতন সহ্য করে যান। অনেক ক্ষেত্রে আবারা যোগ হয় স্ত্রীর পরিবার পরিজনের অত্যাচার- নির্যাতন। আবার স্ত্রী কখনো কখনো ছেলে মেয়েদের নিয়ে দল গঠন করে স্বামীর বিপক্ষে নেমে পড়েন। স্বামী ব্যক্তিটি যতটাই সহ্য করে নেন বিপক্ষ দল ততটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

একজন নারী যতটাই ক্ষমতাধারী হন না কেন তিনি পেশি শক্তিতে অবশ্যই পুরুষটির চাইতে কম। যখন স্ত্রী লক্ষ্য করেন যে, স্বামী তার পেশি শক্তি ব্যবহার করেছে না, তখনই স্ত্রীর সাহস ও শক্তি দুটোই বেড়ে যায়। অর্থাৎ স্বামীর নমনীয়তা, মেনে নেওয়া, সহ্য করা এ বিষয়গুলো স্ত্রীর জন্য এক প্রকার বলবর্ধক হিসেবে কাজ করে।

স্ত্রীদের নির্যাতনের প্রধান এবং সর্বোচ্চ ব্যবহৃত অস্ত্র হচ্ছে তাদের ‘মুখের কথা’ । এই কথার মাধ্যমে তারা বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে ফেলতে যথেষ্ট পটু। স্বামীকে নাজেহাল করার সূত্রগুলোর মধ্যে প্রথমেই চলে আসে তার পরিবার, স্বামীর মা-বোনেরা খারাপ, বাবা-ভাইরা খারাপ, তার বংশ খারাপ ইত্যাদি।

আবার স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা (মুরোদ) নিয়েও যথেষ্ট পরিমাণ অপমান করা হয়। বিবাহিত জীবনের সমস্ত না পাওয়াগুলোর জন্য ঐ স্বামী নামক ব্যক্তিটিই দায়ী। তাছাড়া নিজের বাবার বাড়ির কাছে স্বামীর ভারী পকেট প্রমাণ করতে না পারার যন্ত্রণাতেও স্ত্রী নির্যাতনের বিষ ছিটাতে থাকেন স্বামী নামক ব্যক্তিটির উপর।

নারী নির্যাতন যেমন কয়েক প্রকার হয়ে থাকে, পুরষ নির্যাতনের বিষয়টিও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। যেমন- ১. বাচন বা কথার মাধ্যমে ২. শারীরিক আঘাত দে্ওয়ার মাধ্যমে ৩. যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে ৪. অর্থ কষ্টের বা ভরণ-পোষণ থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে এবং ৫. ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে।

উল্লেখিত সবগুলো উপায়ের মাধ্যমেই একজন স্ত্রী তার স্বামীকে নির্যাতন করতে পারেন। বলা বাহুল্য যে, অনেক স্ত্রী তার যতটুকু শারীরিক বলই থাকুক না কেন, তাই দিয়েই স্বামীকে রক্তাক্ত করে ফেলতে পারেন (এক্ষেত্রে নখের আঁচড়, দাঁতের কামড় সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয়)। কথায় কথায় দরজা বন্ধ করে রাখা, আলাদা জায়গায় শোয়া, স্বামীকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা, তার যত্ন না নেওয়া, কথা বলা বন্ধ করে রাখা, সুটকেস নিয়ে সংসার ফেলে চলে যাওয়া প্রভৃতি নিষয়গুলো ডাল-ভাতের মতো প্রতিনিয়ত স্ত্রীরা ব্যবহার করে থাকেন।

এ ধরনের নির্যাতন সহ্য করেও যেসব স্বামী ২০/৩০ বছর বিবাহিত জীবন কাটিয়ে দেন, তাদের আপনি কি বলবেন? মেরুদণ্ডহীন? মদন? নাকি ভীতু? এ সব নামকরণের মাধ্যমে আমরাও কি তাঁদের নির্যাতনের সঙ্গে আরো এক ধাপ যুক্ত করলাম না? প্রতিটি পুরুষই হয়তো কোনো না কোনো লাভের কথা ভেবেই এসব নির্যাতন, অপমান , যন্ত্রণা সহ্য করে নেন। কখনও ভেবে নেন তার স্ত্রী কোনো না কোনো মনের সমস্যা আছে (যেমন-রাগ), কখনো এটা নিজেরই দূর্ভাগ্য যে কারণে তার শান্তিময় দাম্পত্য জীবন হয়নি, কখনও আবার নিজের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঁচাতে চান সংসার , বাঁচাতে চান সন্তানদের পিতৃ-মাতৃ হারা হওয়া থেকে।

এমনও দেখা যায় যে, স্বামীর মনে স্ত্রীর স্থানটি অন্য কোনো দিক থেকে অটল। ‘বউটি আমার অনেক রাগী হলেও তার বেশ কিছু ভালো গুণ আছে।’ কখনও কখনও স্ত্রীর কাছ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা (যেমন- টাকা পয়সা, বাড়ী গাড়ি) পাওয়ার বিনিময়ে অনেক স্বামী অত্যাচার সহ্য করে নেন অথবা বাধ্য হন। ভেবে নেন- স্ত্রী আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস, একটু রাগারাগি তো করবেই, ওটুকু সহ্য করে নিলেই হয়’।

যাই হোক, যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সেই পুরুষরা কি করবেন? খুব ছোট ও সাহস করে উত্তর দিচ্ছি- প্রথমে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিন কি করতে চান। নির্যাতন বন্ধ করতে চান? নাকি যেমন চলছে চলুক তাই চান। আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান? নাকি পারিবারিক ভাবে তার সমাধান টানতে চান। আপনার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো জানবেন ও বুঝবেন আপনি নিজেই। তাই বুঝেশুনে ব্যবস্থা নিন। লজ্জিত হবেন না, কেননা নির্যাতন যিনি করেন লজ্জিত তিনি হবেন, নির্যাতিত ব্যক্তিটি নয়। আর কাউন্সেলিং-এ আসতে পারেন। তাতে বরং আপনিই উপকৃত হবেন।

তামিমা তানজিন
কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
প্রত্যয় মেডিকেল ক্লিনিক


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Previous articleসেলফাইটিস: নতুন মানসিক সমস্যা
Next articleমিনি’ যেভাবে বেড়ে ওঠে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here