দেশ বাঁচে ভালোবাসায় : জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান

তাঁর প্রকৃত নাম মো. রফি খান। খ্যাতিমান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ তিনি। স্বাধীনতা পদক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী স্বর্ণপদক সহ দেশ বিদেশে অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি। নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে মা ও শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন “ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট”। অবসর কাটান তিনি গান শুনে, খেলা দেখে। স্কুল জীবনে তিনি নিজেও ছিলেন একজন ফুটবলার। স্কুলের হয়ে জিতেছেন অনেক পুরস্কার। তিনি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। মনেরখবর পাঠকের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানাচ্ছেন তাঁর শৈশবের কথা, ভালোলাগার কথা, দেশ ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ মামুন।

মনের খবর:কেমন আছেন স্যার?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি।

মনের খবর: ভালো থাকার জন্য কী করেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: ভালো থাকার জন্য চিন্তা করি যে আমি ভালো থাকবো সুস্থ থাকবো।

মনের খবর: মন খারাপ হয়?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: মন খারাপ তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সে যদি চিন্তাশীল হয়, চেতনামূখী মানুষ হয় তাহলে তো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক।

মনের খবর: মন খারাপ হলে তা ভালো করার জন্য কী করেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: মন ভালো করার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া চাই যাতে সুস্থ থাকি, আমার মন সুস্থ থাকে। মন ভালো রাখতে হলে ভালো চিন্তা করতে হবে- ভালো ভাবনা থাকতে হবে, দেশের কথা ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে কোথায় যাবো আমরা অর্থাৎ এই দুনিয়ার পর আরেক কোন দুনিয়ায় যাবো, কীভাবে আমি আমার জীবন পালন করব।

মনের খবর: স্বপ্ন দেখেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: না, আমি স্বপ্ন দেখি না। একদম না।

মনের খবর: অবসরে কি করেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: অবসরে রিলাক্সেশনের চেষ্টা করি। গান শুনি, খেলা দেখি, আর কোথাও যদি খেলাধুলা হয় তাহলে যাওয়ার চেষ্টা করি।

মনের খবর: এই মুহুর্তে মনে পড়ছে এমন প্রিয় কোনো গানের চারটি লাইন বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: এই মুহুর্তে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান,
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

মনের খবর: কোন খেলার প্রতি আগ্রহ বেশি?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: ছোটবেলায় ভালো ফুটবল খেলতাম। ছোটবেলায় আমার স্কুল ছিল সাতক্ষীরা পিএন হাই স্কুল। সেখানে স্কুল টীমের টিম লিডার হিসেবে ১৩টি ট্রফি লাভ করি। এরপর মেট্রিকুলেশন অর্থাৎ এখনকার এসএসসি পাশ করার পর ইন্টার পড়তে কলকাতা চলে যাই। তারপর আর খেলাধুলা হয়নি।

মনের খবর: প্রিয় ফুটবল দল কোনটি?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: তখন তো তিনটা দল জনপ্রিয় ছিল মোহামেডান, ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান। এই তিনটা দলের খেলাই ভালো লাগতো।

মনের খবর: চিকিৎসক হলেন কেন? 
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: মা বাবা আত্মীয় স্বজনের ইচ্ছে ছিল যে আমি ডাক্তার হই। আমার বড়ভাই মরহুম মো: শফি খান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, আমার ছোটজন জুট টেকনোলজি পাশ করে ব্রিটেনে আছেন, তাঁর ছোট জন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট এবং আর আমি ডাক্তার। একেক ভাই একেক প্রফেশনে।

মনের খবর: চিকিৎসক না হলে কি হতেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: চিকিৎসক না হলে কী হতাম সেভাবে চিন্তা করিনি। চিকিৎসক না হলে হয়তো অন্য পেশায় যেতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ডাক্তার হতে। আমিও সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তাই আর কোনো দিকে ভাবা হয়ে ওঠেনি।

মনের খবর: শৈশবের কোনো স্মৃতি আমাদের বলবেন কি?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: আর সবার মতোই আমার শৈশবটাও ছিল। বল খেলতাম, পুকুরে সাঁতার কাটতাম, স্কুলে যেতাম। টেলিভিশনের প্রসার তখন ছিল না, আমরা রেডিও শুনতাম। তারপর সার্কাস আসলে সবার সাথে সার্কাস দেখতে যেতাম। আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতো আবার কাঁধে করে নিয়ে আসতো।

মনের খবর: দেশের মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: দেশের মানুষ আমাকে চেনে ও শ্রদ্ধা করে ব্যাপারটা আমি নিজে জানি না। তবে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে এটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। তবে শ্রদ্ধা ভালোবাসার ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো আপনি যদি মানুষকে ভালোবাসেন তাহলে মানুষ আপনাকে ভালোবাসবে। এখন সেই অবস্থানে আমি রয়েছি কিনা সেটা নিশ্চিত নই, হয়তো অনেক মানুষ আমাকে অপছন্দও করে। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমাদের রোগীদের সাথে কাজ করতে হয়। সব সময় আমাদের চেষ্টা থাকতে হয়, যে মানুষটাই আসুক তাঁকে একটা ভালো সার্ভিস দিতে। এরমধ্যে অনেকে হয়তো মনে রাখে।

মনের খবর: আপনি দেশের বাইরে ছিলেন কিন্তু সেখানে না থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। কেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: ডক্টর ডিকসন যখন আমাকে বললো, খান তুমি কি আমার দেশে থাকবে? আমি বললাম, দেখো ডিকসন তোমার দেশে আমার মতো হাজারটা লোক আছে। কিন্তু আমার দেশে আমার মতো লোক খুব বেশি নেই। সুতরাং আমার প্রয়োজনটা তোমার দেশের চাইতে আমার দেশেই বেশি। তখন ডক্টর ডিকসন আবারো বললো, আরেকবার ভেবে দেখো। আমি বললাম যে, না আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না। আমি আমার দেশেই চলে যাবো।

মনের খবর: প্রিয় ব্যক্তিত্ব?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন জন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। যেমন ধর্ম বিষয়ে যদি বলি, আমরা মুসলিম এবং আমাদের প্রধান আদর্শ হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর কথা, তাঁর কাজ মেনে চলার চেষ্টা করি, যদিও পারি না সবটা। আবার প্রফেশনাল দিক থেকে যদি বলি তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাঁরা পুরোধা ছিলেন যেমন আমাদের দেশের ডা. ইব্রাহিম। উনি একটা বড় কাজ করে গেছেন দেশের জন্য। চেষ্টা করি উনার মতো যদি কিছু করা যায় যাতে দেশের দশের কোনো উপকার হয়, বিশেষ করে শিশুদের কল্যাণে যদি কিছু করতে পারি।

মনের খবর: শিশুদের বর্তমান জীবন যাপনের সাথে শিশু-স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে কতটা নজর দেয়া হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: শিশুদের বর্তমান জীবন যাপন একজন বাবা মায়ের কাছেও যেমন বেদনাদায়ক আমার কাছেও ঠিক তাই। যে কথাটা আমি প্রায়ই বলি যে শিশুদের পড়ার সাথে খেলা, রিলাক্সেশনের জন্য কিছু উপকরণ চাই। নইলে তারা কম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল হয়ে চোখটা খারাপ করে, শরীরটা খারাপ করে। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের এখন দরকার একটা সংগঠিত পরিকল্পনা। কিভাবে একটি শিশু বেড়ে উঠবে, সকালে স্কুলে যাবে, বিকেলে খেলবে, সন্ধ্যায় মা বাবা দাদী নানীর সাথে গল্প করবে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটা ভিন্ন। স্কুলে এক বোঝা বই দিয়ে দেয়। স্কুলে কি পড়ায় জানিনা, তবে একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে দেয়। তাতে কি হয়, বিকেলে এসে তার একটাই কাজ হলো সেই পড়াগুলো তৈরি করা। তার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, খেলার সময় নেই, বিশ্রামের সময় নেই।

মনের খবর: রাগ হয়?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: হ্যাঁ হয়।

মনের খবর: রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন কিভাবে?
অধ্যাপক ডা. এম আর খান:রাগ হলে তখন একটা কথাই আপনাকে মনে রাখতে হবে, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। তাছাড়া যখন রাগ হয় তখন ব্যক্তিগতভাবে আমি চুপ থাকার চেষ্টা করি।

মনের খবর: মনের খবর পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: মানুষকে ভালোবাসুন, দেশকে ভালোবাসুন। মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালোবাসায়।

মনের খবর: শত ব্যস্ততার মাঝেও মনেরখবরকে সময় দেয়ার জন্য মনেরখবর পাঠকদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান: ধন্যবাদ মনের খবরের সকলকে।

Previous articleআর্থিক অবস্থার উপর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষা প্রয়োজন অভিবাবকদের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here