ডা. আসাদুল বারী চৌধুরী অমি
এমডি ফেইজ-বি রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
কেইস স্টাডি:
তুহিন সাহেব একজন মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী। ব্যাবসায়িক অংশীদার ও সহকর্মীদের অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতোই শখে জুয়া খেলতে শুরু করেন। কিছুদিন বাদে খেয়াল করলেন নিয়মিত জুয়ার আড্ডায় তার অভ্যেস বেড়ে গেছে। ঐ পরিবেশের প্রভাবেই মূলত মাদক গ্রহণ শুরু করলেন। অ্যালকোহল, ইয়াবাসহ সহজলভ্য নানা ধরনের নেশা তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে লাগল। ফলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া।
জুয়া মূলত এক ধরনের বাজি খেলা। এটা এমন একটা খেলা যাতে লাভ বা লোকসান উভয় সুযোগই থাকে। প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে হার-জিত নির্ধারণ হয়। যে পক্ষ হেরে যায়, সে অপর পক্ষকে ঐ চুক্তিবদ্ধ অর্থ প্রদান করে। খেলায় হার বা জিতে যাওয়াতে উভয় পক্ষের ঝুঁকিই থাকে। পুরস্কারের অর্থ জুয়া খেলায় বিজয়ী পক্ষ কখনো সাথে সাথে পেয়ে থাকে, আবার কখনো তা পেতে শর্তসাপেক্ষে দেরিও হয়। পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশে জুয়ার ইতিহাস খেলা বহু পুরোনো। ধারণা করা হয়, ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিসে প্রথম জুয়া খেলার আসর হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বিনোদনের মাধ্যম। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে জুয়ার অন্যান্য মাধ্যমের চাইতে অনলাইন জুয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশও এর প্রভাবমুক্ত নয়। দেশে যেমন গত এক থেকে দেড় দশকে জুয়ার সুযোগ বেড়েছে, এবং এর সংশ্লিষ্ট অপরাধও বেড়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে গোটা বিশ্ব জুড়ে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ জুয়া খেলায় হারিয়েছেন, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। কোভিড কালের পর আরও বেড়েছে এই প্রবণতা। জুয়া খেলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি আমাদের এশিয়াতে, এর মাঝে ভারত ও নেপাল সবচেয়ে এগিয়ে। জুয়াকে কেন সমস্যা মনে করা হয়? মানুষ যখন জুয়ার প্রলোভন ও অভ্যাস থেকে নিজেকে আর দূরে রাখতে পারে না, তখন তাকে এক প্রকার মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই পর্যায়ে জুয়ার কারণে যদি সে তার সর্বস্বও খুইয়ে ফেলে, তবুও কিছুতেই জুয়ার নেশা ত্যাগ করতে পারে না। সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে এই অভ্যেস নিয়ে যেতে পারে আসক্তিতে। আর নেশা চরমে পৌঁছলে জীবনে সমূহ ধ্বংস ডেকে আনে।
মানসিক রোগ নির্ণয়ের ম্যানুয়েল ডিএসএম-৫ (ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিজঅর্ডার) ও আইসিডি-১০ (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ) অনুযায়ী, মানসিক অসুস্থতার বিভিন্ন ভাগ বা পর্যায় বিবেচনা করে জুয়া খেলার তাড়নাকে একপ্রকার আসক্তি বলেই বিবেচনা করা হয়েছে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, জুয়ার নেশা একাধারে বহুদিন স্থায়ী হয়। ও বারবার ফিরে আসে। জুয়ার আসক্তি বা জুয়ার নেশা যখন মানসিক অসুখে পরিণত হয়, তখন কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-জুয়া নিয়ে মনে সবসময়ে একপ্রকার বদ্ধমূল ধারণা থাকে পূর্ববর্তী জুয়া খেলার অভিজ্ঞতা ভুলে এরা পরবর্তী খেলার পরিকল্পনা করে ও অর্থের ব্যবস্থা করে। তারা তাদের জুয়ার প্রতি আসক্তি অন্যান্যদের কাছ থেকে গোপন রাখতে চেষ্টা করে। এরা জুয়া খেলার জন্য অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং ক্রমশই তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। তারা জুয়া খেলার নেশায় নিজেদের এতটাই জড়িয়ে ফেলে যে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোকে অবহেলা করে। তারা জুয়া খেলার জন্য অসৎ পথে টাকা রোজগার করা শুরু করে।
পারিবারিক ইতিহাস, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ, মাদকের প্রতি আসক্তি এবং বয়স-সবকিছুর ক্ষেত্রেই জুয়া খেলার প্রভাব পড়তে পারে। অন্যান্য আসক্তিগত সমস্যার মতো জুয়ার আসক্তিও পুরুষদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।
জুয়া কীভাবে মস্তিষ্কের ওপর কাজ করে?
গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য সব আসক্তির মতোই জুয়ার নেশার পেছনে রয়েছে জিনগত, বংশগত, পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত ও জৈবিক কারণ। সেই সাথে জড়িত মস্তিষ্কের একটি বিশেষ কার্যাবলী যাকে বলে ‘রিওয়ার্ড পাথওয়ে’ (পুরস্কার গতিপথ)। ফলে আমরা যে কাজই করি না কেন, সেটা করতে আমাদের বেশ ভালো লাগে। এর মধ্য দিয়ে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে যে ডোপামিন নিঃসরণ হয় তা এক ধরনের সন্তুষ্টি তৈরি করে। যেকোনো আসক্তির ক্ষেত্রে-হোক সেটা মাদকাসক্তি বা জুয়া-আসক্তি, সেখানে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়, যা আমাদের আবেগের তাড়নাকে অবদমিত করে দুর্বল করে দেয়। গবেষকদের মতে, যাদের মাঝে জুয়ার নেশা রয়েছে তাদের মধ্যে এই ‘রিওয়ার্ড’ অংশ অধিক সক্রিয় থাকে। জুয়া আর মাদক-শব্দদ্বয় পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
কোকেইন, হেরোইন, নিকোটিন, আলোকোহলের মতো জুয়াও মস্তিষ্কের ‘রিওইয়ার্ড সিস্টেম’ বা ‘পুরস্কার/প্রণোদনা কেন্দ্র’-কে সক্রিয় করে। জুয়া একই সাথে নেশার প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়, ফলে অ্যালকোহল, গাঁজা থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত সব ধরনের আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে। জুয়ার সাথে মস্তিষ্কের স্ট্র্যাটাম ও প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সেরর সম্পর্ক আছে। দেখা গেছে, জুয়া-আসক্তি ও মাদকাশক্তি-এই দুই ক্ষেত্রেই স্ট্র্যাটামে বিপাকীয় কাজ কমে যায়। সেই সাথে মস্তিষ্কের অ্যামিগড্যালা ও হিপোক্যাম্পাস নামক অংশের আয়তন কমে। এই দুটি অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও চাপ মোকাবিলার সাথে জড়িত। এ-ও দেখা গেছে, যারা অল্প বয়সের মাদকের জড়িয়ে যায়, তাদের মস্তিষ্কের এই প্রি-ফ্রন্টাল জায়গাগুলো ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকে বেশি থাকে।
কখন বোঝা যায় জুয়ার আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে:
১. যখন প্রতিনিয়ত জুয়ার পেছনে ব্যয়কৃত সময় ও শক্তি দুটোই নষ্ট হতে থাকে।
২. যখন চেষ্টা করেও অভ্যাসটা পরিবর্তন করা সম্ভবপর হয় না।
৩. যখন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক কিংবা কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা শুরু হয়।
৪. যখন পরিবার বা কাছের মানুষের কাছে জুয়া খেলার বিষয়টা লুকাতে হয়।
৫. যখন অর্থ জোগানোর জন্য চুরি বা প্রতারণা করতে হয়।
৬. যখন জমানো টাকা বা সম্পদ ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
৭. যখন টাকা-পয়সা ধার বা দেনা করা শুরু হয়।
৮. যখন জুয়া খেলার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধচক্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়তে থাকে।
জুয়ার ক্ষতিকর দিক কী ধরনের সমস্যা করে?
জুয়ার নেশাজনিত মানসিক রোগের সমস্যা সাধারণত বহুদিন যাবত স্থায়ী হয় এবং যদি এর সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে আনুষঙ্গিক শারীরিক ও মানসিক জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। সেগুলো হলো মূলত যেসব ক্ষতিকর দিক লক্ষ করা যায় তার মধ্যে-
- সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- অর্থনৈতিক সমস্যায় পতিত হওয়া, এমনকি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া।
- আইনগত সমস্যায় পড়া যেমন-থানা-পুলিশ ও জেল-বিষয়ক জটিলতা।
- চাকরিচ্যুত হওয়া।
- সর্বস্বান্ত বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া।
- বিভিন্ন অপরাধ জগতের মানুষের চক্রে জড়িয়ে পড়া।
- নেশা ও অন্য কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া।
- আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
- উদ্বেগজনিত সমস্যা।
- হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়া।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ কীভাবে?
- যদি দেখা যায় কারো পরিচিত ও কাছের কেউ জুয়া খেলার প্রতি আসক্ত, তবে তার সমস্যাটা আগে ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই নেশা থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ দিতে হবে। তবে জুয়াসক্ত ব্যক্তির সুস্থতার জন্য সর্বপ্রথম একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
- ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে। অতীতের সমস্যার কথা বেশি আলোচনা করা উচিত নয়। শুধু বর্তমানের সমস্যায় নজর দিতে হবে।
- জুয়া কীভাবে একজন মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনে সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
- এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কাছের মানুষদের উচিত এই সময় পাশে থাকা এবং পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা।
- জুয়া যে মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। যেমন-কাউকে জুয়াখানা বা ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সতর্ক করা জরুরি, অথবা কারোর হাতে অনেক টাকা দিয়ে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে এমন কাজ করা উচিত নয় যেখানে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।
- সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা তৈরি ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে।
- জুয়া ও মাদকদ্রব্যের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।
- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাড়া-মহল্লায় ব্যাপকভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় ও মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিধিবিধান-সম্পর্কিত ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।
- প্রয়োজনে প্রতিটা পাড়া-মহল্লায় মাদক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে।
- মাদকদ্রব্য উৎপাদন, চোরাচালান, ব্যবহার, বিক্রয় ও জুয়ার সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় বিষয়ে প্রচলিত আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও কঠোর বিধান কার্যকর নিশ্চিত করতে হবে।
- জুয়া ও মাদকাসক্তি ত্যাগে আসক্তদের উৎসাহিত ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে দেশের নেতাদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত।
- বর্তমানে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাকে মনোচিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় বলে ‘কগনিটিভ বিহ্যাইভিওরাল থেরাপি’ বা সিবিটি। সেই সাথে দলগত ভাবে থিক চিকিৎসা গ্রহণের মধ্য দিয়েও এই সমস্যার চিকিৎসা করা হয়।
- সেই সাথে আচরণ পরিবর্তন, চিন্তা পরিবর্তনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়।
- প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ (ফ্যামিলি থেরাপি) দিয়েও চিকিৎসা করা সম্ভব।
- এ ছাড়াও কয়েকটি বিশেষ ধরনের অ্যান্টি-সাইকোটিক শ্রেণীর ওষুধ রয়েছে যা উত্তেজনাকে প্রশমিত করে এই সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
মোট কথা, যেকোনো আসক্তি অগ্রহণযোগ্য। আসক্তি মাত্রই ব্যক্তি, সামাজিক ও অর্থজীবনে অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবন থেকে মাদকাসক্তি ও জুয়ার মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে হলে সঠিক আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করলে দেশ নিঃসন্দেহে মাদক ও জুয়ামুক্ত হবে।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
- চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
মগবাজার রেইল গেইট।
নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
(ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০ - আরো পড়ুন- MK4C-তে কীভাবে টেলিসাইকিয়াট্রি চিকিৎসা নেবেন?