ডা. চিরঞ্জীব বিশ্বাস
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
গল্প-১.
হাসান সাহেব একটি নামকরা ব্যাংকে কর্মরত। সকাল থেকেই মনটা তার খুবই অস্থির। তার ২ বছরের বাচ্চা প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত। গা মুছিয়ে প্যারাসিটামল ঔষধ খাওয়ানোর পরও জ্বর কিছুতেই কমছে না। এদিকে আজকে ব্যাংকে জরুরি মিটিং। তার বস তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন মিটিংয়ে যেন সে অবশ্যই থাকে, তার মেয়ে যতই অসুস্থ থাক না কেন। উপায় না পেয়ে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন। তার বড় ভাইয়ের শ্যালক ডাক্তার। তার সাথে পরামর্শ করে তিনি গাড়িতে তার মা ও স্ত্রীকে বাচ্চাসহ হাসপাতালের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। সময়ের অভাবে হাসান সাহেবের হাসপাতালে যাওয়া হলো না। মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলেও মন পড়ে থাকল হাসপাতালে। মিটিংয়ে তিনি স্বাভাবিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলেন না। বসও হলেন অসন্তুষ্ট। হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর হাসান সাহেবের বাচ্চা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এলো। সাময়িক বাচ্চার অসুস্থতার দুঃচিন্তায় হাসান সাহেবের শরীর ও মন যেন দুটোই প্রাণহীন ছিল। আবার তিনি বাচ্চার সুস্থতায় আবার ও সতেজ হয়ে আগের মতো ব্যাংকের কাজে মনোযোগে ফিরে গেলেন।
গল্প- ২.
রহিম ঢাকা শহরের একজন খেটে খাওয়া দিন মজুর। তার ৫ সন্তান গ্রামে থাকে স্ত্রীসহ। তার নিজের কোনো থাকার জায়গা নিই। দৈনিক আয়ও খুবই কম। যেদিন কাজ পান সেদিন চলে যায় দু-বেলা পেট ভরে খেয়ে। তার আয়ের কিছু জমানো টাকা পাঠাতে হয় বাসায় স্ত্রী ও বাচ্চাদের জন্য। হঠাৎ করে দেশে আন্দোলন। কোনো কাজ নেই। তিনি ভাবেন আজকে না হলেও কালকে একটা সমাধান হবে। কিন্তু সমাধান আর হয় না। খিদে লাগলে পানি খেয়ে পেট পুরে নেন। না খেয়ে এভাবে আর কয়দিন! একবার ভাবেন, রিক্সা চালাবেন। কিন্তু যেহেতু হরতাল চলছে রিক্সা চালিয়ে আয় তেমন হবে না। অগত্যা তিনি আবার গ্রামে ফিরে এলেন, কম আয় হোক তারপরও কিছু কাজ পান। গ্রামে এসে ধান কাটার কাজ পেলেন কয়েকজনকে অনুরোধ করে। আস্তে আস্তে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলো।
গল্প- ৩.
মালেক সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। তার স্বর্ণালঙ্কার দোকানের ব্যবসা। তার ব্যবসায় দুজন বন্ধুও জড়িত। ব্যবসা প্রায় ১০ বছরের বেশি। এক বন্ধু কানাডাতে মাইগ্রেশন করছে তাই তার ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। আরেক বন্ধু হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিনিও ইদানীং ব্যবসাতে সময় দিতে পারছেন না। মালেক সাহেব হঠাৎ করেই ব্যবসার এত চাপে আগে অভ্যস্ত ছিলেন না তার ওপর বয়সও বেড়েছে। এত চাপ কীভাবে সামলাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রেসার ও ডায়বেটিস ইদানীং নিয়ন্ত্রণের বাইরে, রাতের ঘুমও পাতলা হয়ে গেছে তার ওপর দুঃস্বপ্ন। ঘুম থেকে উঠে খুব ক্লান্ত থাকেন। কাজে উৎসাহ ও মনোযোগ কমে গেছে আগের থেকে। সব ছেড়ে বহুদূর চলে যাওয়ার কথা মনে হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে ব্যবসা নিজেকেই সামলাতে হবে কারণ একমাত্র ছেলে সে-ও অস্ট্রেলিয়াতে থাকে; কীভাবে কী করবেন, কীভাবে সামলাবেন সেসব ভেবে বর্তমানে খুবই অন্যমনস্ক থাকেন। বুক ধড়ফড় করে। বুকে মাঝে মাঝে চাপ অনুভূত হয় মনে হয় দম আটকে আসছে। সমস্যার কোনো সমাধান তিনি কারো থেকে পাচ্ছেন না। হঠাৎ করেই একমাস পরে তার ক্যান্সারে ভোগা বন্ধুও মারা গেলেন। এখন মালেক সাহেব পুরোই একা। তিনি ভেবেছিলেন হয়ত তার বন্ধু আরো কিছুদিন পর কানাডা যাবেন। কিন্তু আকস্মিক চলে যাওয়াতে চিন্তার সমুদ্রে পড়লেন। কী করে সব সামলাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
গল্প- ৪.
শাকিল তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় এখন কাটাচ্ছে বলে তার মনে হচ্ছে। বিবিএ পাশ করে এমবিএ করে বেকার বসে আছে দু-বছরেরও বেশি। মাঝে কয়েক মাস টিউশনিও করিয়েছে কিন্তু এখন অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুল বা কলেজের শিক্ষকদের কাছে টিউশনি করাতে পছন্দ করেন। তাই সে টিউশনিও বেশিদিন করা হয়নি। তার অনেক বন্ধু বাসা থেকে টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে কোনো চাকরি না পেয়ে। কিন্তু তার পরিবার মধ্যবিত্ত তাই তার টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। সে হাল ছাড়েনি কিন্তু প্রতিদিন তার বাবা তাকে হেয় করে কথা বলেন যে, সে নকল করে পাশ করেছে না হলে চাকরি হবে না কেন। তার চাচার ছেলের সাথে তুলনা করে নেতিবাচক কথা বলেন যে তাকে দিয়ে কিছুই হবে না জীবনে। তাকে জন্ম দিয়ে তারা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। সে পরিবারের বোঝা, বাসা থেকে সে যেন বের হয়ে যায় কারণ বাবার হোটেলে আর কতদিন, তার লজ্জা নেই, পরিবারের মান সম্মান তার জন্য ধূলোয় মিশে যাচ্ছে, শাকিল চোখে অন্ধকার দেখে একা একা লুকিয়ে কাঁদে। হতাশায় কী করবে না বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। একদিন সকালে সে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে।
গল্পগুলোর নাম কাল্পনিক হলেও সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে। প্রতিটিই গল্পেই জীবনের মানসিক চাপের ফলে কাজের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। কাজের ওপর মানসিক চাপের প্রভাবে দিনকে দিন তাদের সমস্যা আরো বেড়েছে।
প্রথম গল্পটিতে বাচ্চার অসুস্থতাজনিত মানসিক চাপে কাজের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে বাচ্চার সুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে আবার কাজের স্বাভাবিক গতি পেয়েছে। সামান্য কিছুদিনের মানসিক চাপ মানুষ সহজে সামলে নিতে পারে, সেজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রয়োজন নেই কারণ সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় গল্পটিতে হঠাৎ করে কাজ না থাকা দিনমজুর রফিককে মানসিক চাপের মুখোমুখি করেছে, তারপরও তিনি পুরোপুরি হতাশ হননি এবং শেষ পর্যন্ত অন্যদের পরামর্শে গ্রামে কাজ পাওয়ার কারণে আবার তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যান, এখানে সমস্যা বড় হলেও ধৈর্য ও স্থিরতা তাকে পুরোপুরি ভেঙে যেতে দেয়নি।
তৃতীয় গল্পে, ব্যবসায়ী ভদ্রলোক হঠাৎ কাজের চাপে পড়ে যান যার জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি এটা মেনেও নিতে পারছিলেন না। নিজেও সমাধান করতে পারছিলেন না, কারো সাহায্য পাচ্ছিলেন না। মানসিক চাপে ও দুশ্চিন্তায় আস্তে আস্তে তার বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এতে তিনি তার স্বাভাবিক জীবনের কর্মচাঞ্চল্য হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান।
চতুর্থ গল্পে, একজন বেকার যুবক চাকরি না পাওয়াতে কিছুটা মানসিক চাপে ভুগছিল কিন্তু তার পরিবার তাকে মানসিক চাপ মোকাবেলায় সাহায্য না করে তাকে দোষারোপও তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে। হয়ত পরিবার তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলে ও সাহায্য করলে সে পরিবারের গর্বের কারণ হতে পারত। আমাদের কর্মজীবনের বিভিন্ন চাপে আমরা যেকোনো সময় বিপদগ্রস্ত হতে পারি, তাই সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ শুধু মানসিক চাপকে মোকাবেলা শেখাবে না বরং ভবিষ্যতে নিজেদের কাজে আরো দক্ষ, পরিপক্ক ও ধৈর্য বাড়িয়ে কাজে সফল হতে শেখাবে।
কখন আমাদের বিশেষ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন?
- মানসিক চাপের কারণ সমাধানযোগ্য নয় বলে মনে হলে
- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আন্তরিক না থাকলে
- মানসিক চাপ অনেক দিনের ও সমাধান হচ্ছে না এবং কাজে সমস্য হচ্ছে-এরকম পরিস্থিতিতে
- মানসিক চাপ অল্প দিনের কিন্তু দুশ্চিন্তায় ঘুম, খাওয়া, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলে
- নিজের ধৈর্য ও স্থিরতা কম হলে
- মানসিক চাপ মোকাবেলায় অভিজ্ঞতার অভাব থাকলে
- পরনির্ভরশীল বা সিদ্ধান্ত নিতে আত্মত্মবিশ্বাসের অভাব থাকলে
- মানসিক চাপে আত্মহত্যার চিন্তা এলে সংকট, প্রতিকূলতা জীবনেরই অংশ। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এগুলোকে মোকাবেলা করে। নিজে নিজে মোকবেলা করতে না পারলে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে যথাসময়ে। তাহলেই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ধরে রেখে সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যোগাযোগ করুন- APPOINTMENT
আরও দেখুন– আবেগ নিয়ন্ত্রণ কেন প্রয়োজন?