হাইপোকন্ড্রিয়াসিস: অহেতুক বড় অসুখের দুশ্চিন্তা

শারীরিক রোগ বা শরীরের নির্দিষ্ট কোনো সমস্যাকে ঘিরে যে কয়টি মানসিক রোগ রয়েছে ‘হাইপোকন্ড্রিয়াসিস’ তাদের মধ্যে অন্যতম। এ রোগে আক্রান্ত একজন মানুষ সারাক্ষণ ভাবতে থাকেন, আমার মনে হয় বিরাট কোনো রোগ হয়েছে। এ ভাবনাটি সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো একটি রোগ বা নির্দিষ্ট কোনো সিম্পটমকে ঘিরেই হয়ে থাকে। রোগটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা না থাকলে এ রোগটি চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠে। মানুষ বারবার একই পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে যান আর কদিন পর পর ডাক্তার পরিবর্তন করেন।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিস
এটি একটি মানসিক রোগ। আক্রান্ত মানুষটি সারাক্ষণ একটি নির্দিষ্ট কোনো একটি শারীরিক রোগ বা সমস্যা নিয়ে ভাবতে থাকেন। ভাবেন আমার মনে হয় ঐ রোগটি হয়েই গেছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা কিংবা অন্য সব প্রক্রিয়াতে যতই বোঝানো হোক যে তাঁর সে ধরনের কোনো রোগ নেই বা থাকার কোনো সম্ভাবনাও নেই। সাধারণত রোগটির ধরণও হয়ে থাকে একটু সিরিয়াস ধরনের। যেমন আমার মনে হয়, ক্যান্সার হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, এমন একটি রোগ হয়েছে যেখান থেকে আমার চিকিৎসা হবেনা বা চিকিৎসা নেই।
দেখা নির্দিষ্ট কোনো একটি সিম্পটমকে ঘিরেই এই সমস্যাটি বেশি হয়। যেমন কারো হয়তো বুক জ্বলছে বা ব্যথা করছে, ব্যথার কারণ হয়তো এসিডিটি। কিন্তু আক্রান্ত মানুষটি ভাবতে থাকবেন আমার পেটের কোনো জায়গায় ক্যান্সার হয়েছে। কারো হয়তো গলায় কোনো কারণে কোনো একটি সমস্যা হয়েছে, তিনি ভাবতে থাকেন আামার থাইরয়েডের বিরাট কোনো সমস্যা হয়ে গেছে। হাত পা একটু কাঁপলো হয়তো ভাবলেন আমার পারকিনসনিজম হয়ে গেছে। শত ব্যাখ্যাতেও কোনো সঠিক গ্রহণযোগ্যতা সেই মানুষটির মধ্যে থাকেনা।

রোগের ধরন
বলা হয় নির্দিষ্ট কোনো একটি সিম্পটম এর মিসইন্টারপ্রিটেশন বা ভুল অনুভূতির কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। তবে সব সময় যে কোনো একটি সিম্পটম থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কখনো কোনো ধরনের সিম্পটম বা সমস্যা না থাকা অবস্থায়ও এমন ধরনের অনুভূতি বা উপলব্দি হতে পারে।

নির্দিষ্ট সেই রোগটি নিয়ে যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হোক, ফলাফল কিছু না পাওয়া গেলেও আক্রান্ত মানুষটি কিছুতেই সেই বিষয় থেকে তার বিশ্বাস সরাতে পারেন না।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিস অনেক সময় হয়ে থাকে এপিসোডিক অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর হতে পারে। কখনো মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত এমন চিন্তা বা সমস্যা থাকতে পারে। আবার এমনিতেই চলে যেতে পারে। তবে একটি বিষয় হলো, কারো সমস্যা যদি কমপক্ষে ৬ মাস না থাকে তবে সেটিকে হাইপোকন্ড্রিয়াসিস বলা যাবেনা।

আক্রান্ত মানুষটির কি হয়?
কোনো কাজে মন দিতে পারেননা। তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি পেশাগত কাজেও বিশাল প্রভাব পড়ে। অনেকে রোগটি নিয়ে এতই চিন্তিত থাকেন যে, অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে রোগটির চিকিৎসা এবং এ সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই বেশির ভাগ সময় পার করে দেন। নিকট আত্মীয় স্বজন অনেক সময় বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত হয়ে যান। অনেকে প্রাথমিক সহানুভূতিটুকুও উঠিয়ে নেন।

নির্দিষ্ট সেই চিন্তাটির সাথে নতুন করে যোগ হয়, এনজাইটি বা ডিপ্রেশন সহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা। রোগী নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করেন। নির্দিষ্ট রোগটি ধরা পরছেনা। কিভাবে কোথায় কবে রোগটি ধরা পরবে (?), ভাবেন দিনে দিনে হয়তো অন্য আরো কোনো রোগে রুপান্তরিত হতে পারে। অনেকে এমনকি আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভাবা শুরু করেন।

কাদের বেশি হয়ঃ
দেখা যায় যত মানুষ বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যায়, তার অন্তত ৪ থেকে ৬ ভাগ মানুষেরই এই রোগটি থাকার বা হবার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত ত্রিশ বছর বয়সের আগেই এ রোগে আক্রান্ত হয়। মহিলা পুরুষ দুজনেরই সমান সম্ভাবনা থাকে।

তবে মোটা দাগে বলতে হবে, পিছনে অবশ্যই কোনো না কোনো মানসিক চাপ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে থাকে।

চিকিৎসা:
সাইকোএডুকেশন: সর্বপ্রথমেই রোগটি সম্বন্ধে ভালো ধারণা তৈরি হওয়া দরকার। তা না হলে ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে সব চিকিৎসা বাদ দিয়ে শুধু কষ্টই করতে হবে। রোগী, পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সহ সকলের মানসিক রোগটি বিষয়ে ভালো ধরাণা থাকা লাগবে। রোগটির বিষয়ে রোগী ও আত্মীয়স্বজনকে ভালো করে বুঝানো। দরকারমতো তথ্য উপাত্ত সহ বিশ্লেষন করা। রোগের বিষয়ে তাঁদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা।
সতর্কতা: যখন বোঝা যাবে যে সত্যিই কোনো শারীরিক রোগ নেই তখন অপ্রয়োজনীয় যে কোনো ধররেন পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে, যতবারই পরীক্ষা করতে দেয়া হবে ততবারই রোগীর মনে নতুন আশা তৈরি হবে এবং মনে হবে পরীক্ষাটি ঠিক মতো করা হয়নি বা সময় মতো করা হয়নি। তাতে সমস্যা আরো বাড়ে।

ওষুধ ও সাইকোথেরাপী: উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা বা অস্থিরতা কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা জরুরি। সাধারণত এন্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা হয়। সাইকোথেরাপী সাধারণত চাপের সাথে মানিয়ে চলার পদ্ধতিগুলি এরোগের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী হয়। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা অনেক সময় সময়সাপেক্ষ কিন্তু খুব বেশি জটিল নয়।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleবডি ডিজমরফিক ডিজঅর্ডার: রোগী যখন নিজের কোনো অঙ্গকে অস্বাভাবিক ভাবে
Next articleআপনার মেয়ে উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছে
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here