শিশুর বুদ্ধি বিকাশের অন্তরায় যে বিষয়গুলো

শিশুর বুদ্ধির বিকাশের অন্তরায় যে বিষয়গুলো

আমরা অভিভাবক কিংবা শিক্ষকরা শিশুর শিক্ষা নিয়ে যতটা চিন্তা করি, শিশুর বিকাশ ও আনন্দ নিয়ে ততটা ভাবি না। আর ভাবি না বলেই শিশুকে নিয়ে ভোর থেকে ছুটছি কথিত ভালো শিক্ষক কিংবা কোচিং সেন্টারে।

উদ্দেশ্য শিশুটিকে হয় নামী স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেতে হবে অথবা পরীক্ষায় অধিক নম্বর পেতে হবে। হতে হবে ক্লাসের সবার সেরা। পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ কিংবা অধিক নম্বর প্রাপ্তিই মূল উদ্দেশ্য। অথচ যাকে এই নম্বর পেতে হবে তার হয়তো সে বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই।

এখন শিশুর বয়স চার কিংবা পাঁচের ঘরে পড়তে না পড়তেই শুরু হয় দৌঁড়ঝাপ। পরীক্ষায় অধিক নম্বর পেতে হবে, ক্লাসে প্রথম হতে হবেÑ এগুলো শিশুর ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ। শিশুরা বিষয়টি ভালো করে বুঝেও ওঠে না।

কারণ মানব শিশুর পাঁচ বছর বয়সের আগে যৌক্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ শুরুই হয় না। তাহলে প্রশ্ন এসেই যায় এই বয়সের শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ কি ঘটে না? সত্যি কথা কি যৌক্তিক বুদ্ধির ধারণা আর বৃদ্ধির বিকাশের ভেতর অনেক পার্থক্য আছে।

বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে একটা গল্পের ভেতর দিয়ে। ধরা যাক মধ্যবিত্ত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের মিস্টার ও মিসেসের একমাত্র সন্তান রুমকি। তার বয়স চার বছর। সে সর্বদা হাসি-খুশি ও বেশ চঞ্চল। সারাদিন এটা-ওটা করতে থাকে বাসায়। দুনিয়ায় যা দেখে তাতেই তার আগ্রহ। মাকে সে নানা প্রশ্ন করে সব সময় ব্যতিব্যস্ত রাখে। মাও চেষ্টা করেন সাধ্যমতো তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে।

শুধু তা-ই নয়, মা রোজ নিয়ম করে নানা ধরনের পুষ্টিকর খাবার দেন তাকে, যাতে তার শরীরের বৃদ্ধি হয় ঠিকঠাকমতো। মা এবং বাবা সময় করে তার সঙ্গে নানা ধরনের খেলা খেলে। বাবা তার সঙ্গে গল্প বলে। মা গল্পের বই পড়ে শোনায়। ছুটির দিনে বাবা-মা তাকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে নিয়ে যায়। নিয়ম করে বাসার কাছে মাঠে খেলতে নিয়ে যায় তাকে।

বাবা-মায়ের এ ধরনের কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে রুমকি দিনে দিনে বেড়ে উঠছে। তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক উভয় দিকের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটছে নিঃসন্দেহে। তাকে প্রশ্ন করলে সে তার উত্তরও দিতে পারে কম-বেশি। এগুলোই হলো তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের লক্ষণ।

একদিন রুমকির বাবা কাজ থেকে বাসায় ফিরে তার সঙ্গে গল্প করতে বসেছে। হঠাৎ করেই রুমকির বাবা তার কাছে প্রশ্ন করল, আজ সারাদিন সে কী কী করেছে? সঙ্গে সঙ্গে রুমকি বলতে শুরু করল। সে বলে চলেছেÑ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খেয়ে সে মাঠে খেলতে গেল। হাত-মুখ ধুয়েছে। গোসল করেছে। দুপুরের খাবার খেয়েছে। ঘুমিয়েছে। মায়ের সঙ্গে খেলেছে ইত্যাদি।

সারাদিন যা যা করেছে প্রায় সব বলে গেল কিন্তু আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব, সবই বলেছে কিন্তু তার বলার ভেতর ঘটনার পরম্পরা নেই। কোনটার পর কোনটা সেটার মিল নেই কিন্তু ঘটনাগুলো সবই সে বলেছে। এই যে রুমকি সব বলতে পারল কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বলতে পারল না এটা তার জন্য দোষের কিছু না। কেননা তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঠিকই ঘটেছে কিন্তু এগুলোর যৌক্তিক বিকাশ এখনো শুরু হয়নি; মানে তার সেই বয়স এখনো হয়নি।

শিশুদের সাধারণত চার বছরের পর থেকে একটু একটু করে যৌক্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ শুরু হয়। রুমকির বয়স এখন চার, ফলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বুদ্ধির যৌক্তিক বিকাশ এখনো সেভাবে শুরু হয়নি।

শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে জন্মের পর পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত। শিশু বয়সের এই সময়কালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। শিশু সর্বদা সরল, বিশ্বাসী এবং প্রাণবন্ত। এই প্রাণবন্ততা ও হাসি খুশির সঙ্গে শিশুর বেড়ে ওঠার একটা শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। অভিভাবক থেকে শুরু করে পরিবার ও অন্যরা শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির জন্য বেশি মনোযোগ দেন কিন্তু শরীরের সঙ্গে মনের যে যোগ আছে; সেটা আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানষ গুরুত্ব দেন না।

শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার শারীরিক বিকাশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার মন বা মানসিক গুণাবলির বিকাশও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশের থেকে মানসিক বিকাশের প্রতি বেশি নজর দেয়া উচিত। কেননা শারীরিক ঘাটতি যে কোনো সময় চিকিৎসা ও সঠিক পরিচর্যার দ্বারা পূরণ করা গেলেও মানসিক ও মানবিক গুণাবলির অপূর্ণতা কোনোকালে কিছুতেই পূরণ করা সম্ভব হবে না।

বেশিরভাগ অভিভাবক এমনকি আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর মন ও মানবিক গুণাবলি বিকাশের দিকটা অতটা আমলে নেন না। তারা মনে করেন কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাঠ মুখস্থ ও পরীক্ষায় অধিক নম্বর প্রাপ্তির ভেতর শিশুর সোনালি ভবিষ্যৎ নিহিত।

তাই তিন-চার বছরের শিশুকে ভোরবেলা ঘুম চোখে মা এক হাতে নাশতা ও অন্য হাতে কয়েক কেজি ওজনের বই-খাতার ব্যাগটি নিয়ে হাজির হন স্বপ্নের আদর্শ নাগরিক তৈরির কারখানায়; তথা স্কুলে। শিশুর তখনো চোখ থেকে ঘুম কাটেনি। কিন্তু উপায় নেই তার। তাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বই মুখস্থ করার দিকে মনোযোগ দিতে হয়।

আমাদের দেশে মূলত এই বয়স থেকেই শিশুর স্বপ্ন হরণ ও ইচ্ছের মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এতে শিশুর জীবন থেকে যেমন আনন্দ ছুটে যায়, তেমনি রাতের ঘুম হারাম হতে থাকে শিশুর পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে বাবা-মার। অন্যদিকে মানুষ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিত্ত-বৈভবে আঙুল ফুলে কলাগাছের মতো হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সমাজে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতে শিশু কি আনন্দ পায়? যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিশু মন ও তার মনস্তত্ত্বকে গুরুত্ব দেয়া হয় না, তা কী করে শিশুর কাছে আনন্দময় হবে? যে বয়সে শিশুর গল্প শুনে ও বলতে বলতে তার ভাষার বিকাশ হওয়ার কথা কিংবা খেলতে খেলতে শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ হওয়ার কথা অথবা প্রকৃতি দেখে বলতে ও চিন্তা করতে শেখার কথা বাস্তবে তার কতটুকু হচ্ছে?

অন্যভাবে বলা যায়, শিশু দেখে, শুনে ও নিজে করতে করতে শেখার কথা তার কতটুকুর চর্চা হচ্ছে দেশের শিক্ষা অঙ্গন তথা স্কুলগুলোতে? দেখে, শুনে ও করতে করতে শেখার মধ্যে আনন্দ আছে। সেই আনন্দইবা কতটুকু আছে আমাদের শিশু শিক্ষাব্যবস্থায়?

শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক নিয়ে বাঙালির মহান ব্যক্তিত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়, যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না।

কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি শিশুকে চারাগাছের সঙ্গে তুলনা করেন। চারাগাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিমাণমতো আলো, বাতাস, পানি আর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া যেমন চারাগাছ সঠিক মাত্রায় বেড়ে ওঠে না; তেমনি শিশুর সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য পরিবেশ ও পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে চারাগাছ যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে ওঠে; তেমনি শিশুর বেড়ে ওঠার ভেতরও একটা স্বতঃস্ফূর্ততা কাজ করে।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছেন, শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। দেশে বর্তমান প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে শিশুশিক্ষায় যেমন উপেক্ষিত শিশুর মন ও মনস্তত্ত্ব; তেমনি নেই আনন্দময় শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি ও স্বতঃস্ফূর্ত মত প্রকাশের সুযোগ।

একটি দেশের শিশুশিক্ষা ব্যবস্থায় এই বিষয়গুলোর অভাব মোটেই ভালো কিছুর লক্ষণ না। সোনার বাংলায় সোনার মানুষ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থায়র সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই।

আমাদের শিশুশিক্ষা ব্যবস্থাকে শিশুবান্ধব ও আনন্দময় করার জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো:

প্রথমত- অভিভাবকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতার পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে, শুধু লিখতে-পড়তে পারা আর পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াই শেষ কথা না। আসল কথা হলো শিশুকে মানবিক গুণে মানুষ হতে সাহায্য করা।

দ্বিতীয়ত- শিশুশিক্ষার জন্য আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা। এটা করার জন্য শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি তথা অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাপদ্ধতিগুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। পাশাপাশি শিশুর জন্য যেসব শিক্ষা উপকরণ তৈরি করা হবে, সেগুলোয় শিশুর মন ও তার চারপাশের চেনা জগতের বিষয়বস্তু, ঘটনা, চরিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে।

তৃতীয়ত- শিক্ষা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহী ও সৃজনশীল মানুষকে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

চতুর্থত- শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার বিশেষ করে শিক্ষকদের সামাজিক ও আর্থিক পদমর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত- পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেননা যত পদ্ধতি, উপকরণ আর ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক না কেন, শিক্ষক যোগ্য, দক্ষ ও নিবেদিত না হলে শিশুর সর্বোত্তম বিকাশ নিশ্চিত হবে না। তাই অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি প্রকৃত শিক্ষক যাতে গড়ে ওঠেন, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক: মো. সাইফুজ্জামান রানা

শিক্ষা উন্নয়নকর্ম

Previous articleআমি কি বিয়ে করতে পারবো?
Next articleযৌনতা ও আমাদের ভুল ধারণা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here