যখন একজন প্রিয়জনের মানসিক অসুস্থতা ধরা পড়ে

0
91
ক্লসট্রফোবিয়া

দুরারোগ্য মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীর যত্ন নেওয়া একটি অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। একজন পরিচর্যাকারীকে নিজের প্রিয়জনের জন্য অনেক কাজ করতে হয় , যেমন তাদেরকে ওষুধ খাওয়ানো, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, তাদের খাওয়াদাওয়ার খেয়াল রাখা, তাদের অর্থনৈতিক চাহিদার দিকে নজর রাখা, ইত্যাদি।

পরিচর্যাকারীকে রোগীদের স্বভাবগত পরিবর্তনের সঙ্গেও নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে অনেক চাপ সৃষ্টি হয়।

প্রিয়জনের মানসিক রোগ ধরা পড়ার পর থেকে, তাদের পরিচর্যা করার শেষ দিন পর্যন্ত একজন পরিচর্যাকারীর মনের মধ্যে অনেক মানসিক পরিবর্তন আসে। এইটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক, বেশির ভাগ পরিচর্যাকারীর ক্ষেত্রে।
এক একজন ব্যক্তি পরিস্থিতির সঙ্গে আলাদা ভাবে প্রতিক্রিয়া করেন। কেউ কেউ ব্যাপারটিকে খুব হালকা ভাবে নেন, আবার কেউ কেউ খুব চাপ নিয়ে ফেলেন, ফলে তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা পরিচর্যাকারীদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার একটি তালিকা তৈরি করেছেন:

অস্বীকার করা
যখন একজন পরিচর্যাকারী প্রথমবার মানসিক রোগের (সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার) কথা জানতে পারেন, তখন তাদের মনে হতে পারে যে এটি সাময়িক এবং ক’দিন পর এটি সেরে যাবে। সচেতনতা না থাকার কারণে তাদের মনে হয় যে এই রোগ খুবই সামান্য একটি ব্যাপার। যখন সেই রোগী সেরে ওঠার কোনও লক্ষণই দেখাননা, তখন পরিচর্যাকারীরা চিন্তা করতে শুরু করেন। তবুও তারা ব্যাপারটিকে অস্বীকার করেন এবং ভাবেন যে এসব হচ্ছে কোনও ধর্মীয় কারণের জন্য, বা কালো জাদুর জন্য। সেই ভেবে তারা আরও পুজো ও দেব দেবীর আরাধনা করতে শুরু করেন। নিজেদের প্রিয়জনের রোগের সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে এবং তাদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পরিচর্যাকারীদের সময় লাগে।

রাগ হওয়া
পরিচর্যাকারীরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করা শুরু করেন: আমার পরিবারের সঙ্গেই এরকম হল কেন? এর জন্যও কি আমি দায়ি। প্রথম প্রথম তারা নিজদের কে দোষী মনে করেন, তারপর তারা আসতে আসতে পরিবারে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে শুরু করেন। যখন একজন শিশুর মানসিক অসুস্থতা, যেমন হতাশা, দুশ্চিন্তা, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা দেখা যায়, তখন মা বাবারা তাদের সন্তানের বন্ধুবান্ধবদের দায়ী করেন এবং অনেক সময় বলে থাকেন এমনটি হয়েছে কারণ তারা তাকে র‍্যাগিং করেছে। অভিভাবকরা অনেক সময় কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও দায়ি করেন এই ভেবে যে তারা তাদের সন্তানের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করছেন। যারা কর্মরত, তাদের মা বাবা ভাবতে পারেন যে তাদের কর্মক্ষেত্রে অত্যাধিক চাপের জন্যও তাদের ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বেশিরভাগ সময় এরকমটি মনে করাই স্বাভাবিক। এটি উপকারিও কারণ এর মাধ্যমে নিজেদের রাগগুলিকে বের করে আনা যায়। এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আপনি আপনার সন্তানের সঠিক ভাবে যত্ন ও চিকিৎসা করাতে পারবেন।

নিজেকে বোঝানো বা রক্ষণশীল হয়ে পড়া
যদিও একজন ব্যক্তি দুরারোগ্য মানসিক অবস্থায় ভুগতে থাকেন, একজন পরিচর্যাকারীর মনে হতে পারে যে রোগীর অবস্থা এমন কিছু শোচনীয় না এবং তারা নিজেকে বোঝাতে থাকেন এগুলি সবই ভাগ্যের দোষ। তাদের এও মনে হয়, যে ডাক্তার রোগীকে সম্পূর্ণ ভাবে সারিয়ে তুলতে পারবেন।

তারা মাঝেমাঝেই খুব রক্ষণশীল হয়ে পড়েন যখন তারা তাদের মতবিরোধী কোনও কথা-বার্তা শোনেন বা পড়েন। আপনার প্রিয়জনকে আপনার চেয়ে ভাল করে আর কেউ চেনেন না, তবে রক্ষণশীল হয়ে পড়লে বেশি কিছু ভাবনাচিন্তা করা যায় না। তখন আপনি কারোর সাহায্যর থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। একজন বন্ধু বা সমাজসেবী হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারেন যদি আপনি তাঁদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে চান।

বিরক্তিভাব
অনেক পরিচর্যাকারীই এটি মানতে চান না, তবে তাদেরও অনেক সময় বিরক্ত লাগে। এই বিরক্তির কারণ হয় সমাজের কুণ্ঠা বা নিজেদের ভাললাগা বা নিজেদের ইচ্ছাগুলিকে পরিচর্যা করার কারণে বিসর্জন দেওয়া। পরিচর্যাকারীর আরও বিরক্ত লাগে, কারণ অনেক সময়য় রোগীর যত্ন নেওয়ার জন্য কেউ তাদের পাশে এসে দাড়ান না। পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের মনে হতে পারে যে যিনি যত্ন নেন, তার একমাত্র দায়িত্ব হল রোগীর যত্ন নেওয়া, এছাড়া তাদের জীবনে আর কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিচর্যাকারীই মহিলা এবং যদি তাদের সারা দিন কোনও ব্যক্তির যত্ন নিতে হয়, তাহলে তাদেরকে তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে অবিলম্বে বিরতি নিতে হয়। তারা সমাজের দিক থেকেও সাহায্য না পেতে পারেন, কারণ ভারতের সমাজে সকলেরই ধারণা মহিলারা শুধু ঘরের কাজ করার জন্যই রয়েছেন।

যখন একজন পরিচর্যাকারীকে নিজের কর্মজীবন, বিয়ে, স্বাস্থ্য ও বাইরের কাজগুলি বিসর্জন দিয়ে এগুলি করতে হয় তখন তাঁদের রাগ ও বিরক্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বিষাদ
আমাদের মনে হতে পারে কোনও পরিচর্যাকারীরই মনে বিষাদ হয় না, কারণ তারা সবসময়ই মুখে হাসি নিয়ে চলেন। কিন্তু এটি সবসময় ঠিক না। অনেক সময় মানুষের বিষাদের কারণে তাদের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু তাদের মনে এই ধরণেরই আরেকটি অনুভুতি জন্মায়, যাকে বলা হয় প্রাথমিক বিষাদ। এই অনুভূতি পরিচর্যাকারীর ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায়, কিন্তু এটি বেশিরভাগ সময় দেখা যায় মধ্যবয়সে বা অ্যালঝাইমার, ডিমেনশিয়া বা ক্যান্সারের কারণে।

যদি আপনার অনুভূতি, দুঃখ ইত্যাদির প্রতি সচেতন হন এবং তা আপনার কোনও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিকে জানাতে পারেন, তাহলে খুব সাহায্য হয়। সবসময় হাসিমুখ করে থাকলে, সত্যিটা চাপা পড়েই থাকে, যা মেনে নেওয়া আরও কষ্টকর। নিজের জন্যও সময়য় বার করে নিজের পছন্দমত কাজগুলি করুন। এর জন্য আপনি ভাল থাকবেন।

চিন্তা
যতই আমরা চেষ্টা করি না কেন, আমরা সবসময় চিন্তামুক্ত থাকতে পারিনা। আমাদের প্রিয়জনের পড়াশুনা, টাকা পয়সা, বিয়ে ইত্যাদি নিয়ে আমাদের চিন্তা হয়। আমাদের মনে সবসময় চিন্তা হয়, যে আমরা মারা গেলে তাঁদের কি হবে। চিন্তিত হওয়া ভাল, তবে বেশি চিন্তা করলে নিজেরই কাজ করতে সমস্যা হবে, ঘুমাতে সমস্যা হবে, মাথা ব্যাথা, গায়ে ব্যাথা ও নানা রকম অসুস্থতা দেখা দেবে। যদি বেশি চিন্তার কারণে আপনার মধ্যে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে, তাহলে চিন্তা করা বন্ধ করুন এবং একজন চিকিৎসক বা পরামর্শকের সাহায্য নিন।

হতাশা, লজ্জা
এই অনুভূতিগুলি পরিবাবের সদস্য বা মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগী, দুজনেরই হতে পারে। পরিবার লজ্জিত হতে পারেন মানসিক রোগকে ঘিরে সমাজে প্রচলিত কুণ্ঠার কারণে। তারা তাদের আত্মীয় বা বন্ধুদের এই বিষয়ে বলতে ভয় পান যাতে সমাজ তাদেরকে একঘরে না করে দেয়।

পরিচর্যাকারীর মতোই রুগীও এই সমস্যার সম্মুখীন হন। তারাও সমাজে প্রচলিত কুণ্ঠা ও বৈষম্যের কারণে নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতিগুলি কাউকে বলতে ভয় পান। একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ যুবকের বাবা বলেছেন, “এই কারণে লোকজন তাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং কেউ তাদের কোনও অনুষ্ঠানেও নিমন্ত্রণ করেন না।”

গ্লানি
পরিচর্যাকারীদের নিজেদের মধ্যে একটি অদ্ভুত অনুশোচনা বোধ কাজ করতে থাকে। তারা মনে করতে থাকেন যে তারা নিজেদের প্রিয়জনের যথেষ্ট যত্ন নেন না, সঠিক ভাবে আচার আচরণ করেন না, সঠিক সময় সঠিক কাজটি করেন না বা মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন নন। তাদের মনে হতে থাকে, এটা করলে ভাল হত বা ওটা করলে ভাল হত, ইত্যাদি। যেমন, “আমার ছেলের চিকিৎসাটা আর কটা দিন আগে করালে পারতাম।” “আর একটু ধৈর্যের সঙ্গে তাদের কে দেখলে পারতাম,” ইত্যাদি।

গ্লানিবোধ কমানো যায় না আর এটি আরও বেশি হতে থাকে যখন রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে এগোয়। এই সব কারণে তারা হতাশায় ভুগতে শুরু করেন এবং অনেক সময়য় তাদেরও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

হতাশা
বেশিক্ষন ধরে রোগীর পরিচর্যা করার কারণে একজন পরিচর্যাকারীর উপর অনেক মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এই চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে তারা মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারেন। পরবর্তী কালে সেটাই হতাশায় পরিণত হয়। ডাক্তাররা সে ক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীদের সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন, যাতে তারা নিজেরা সেরে উঠে একজন রোগীর পরিচর্যা করতে পারেন।

মেনে নেওয়া
যদি একজন পরিচর্যাকারী দেখেন যে তারা নিজেদের প্রিয়জনের সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না, তখন তারা একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নেন। তারা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেন। চিকিৎসার সঙ্গেও তারা পুজো বা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য দেখাতে থাকেন। ডাক্তাররাও সে ব্যাপারে কিছু নিষেধাজ্ঞা করেন না, যতক্ষন তা রোগীর কোনও ক্ষতি করেছে।

পরিচর্যাকারীর অনুভূতি, যখন একজন মহিলা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন
পরিচর্যাকারীরা বেশি চিন্তিত হন যখন একজন মহিলা মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। সমাজে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, যে একজন মেয়ে বিয়ে করলে তার জীবন ভাল হয়ে যায়। একজন মহিলার মানসিক রোগ ধরা পড়লে তার পরিবারের সদস্য চিন্তিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে তারা কি করে একা জীবন কাটাবেন এবং কবে তাদের বিয়ে হবে। একজন অবিবাহিত মেয়ের মা বলেছেন, “একটি পরিবারকে তার মেয়ের অসুস্থতার কথা লুকোতে হয়েছে কারণ সে অবিবাহিত। যদি আমরা সবাইকে তার অসুস্থতার কথা বলি, তাহলে কেউ তাকে বিয়ে করবে না।”

আমাদের সমাজে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটি আলাদা, কারণ সে বিয়ে করে বাড়িতেই থাকে এবং তার মা-বাবারা তাকে সাহায্য করেন। কিন্তু একজন মহিলাকে যেতে হয় তার স্বামীর ঘরে, যেখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই সে আর নিজের পরিবারের সাহায্য পায় না। তার পরিবারের লোকজন চিন্তা করেন যে তার স্বামী বা তার শ্বশুর বাড়ি থেকে তার এই সমস্যা মেনে নেবেন কিনা। মানসিক রোগের দিক দিয়ে দেখতে গেলে সমাজ পুরুষদের চেয়ে, মহিলার প্রতি বেশি কুণ্ঠা বোধ করেন। এই কারণেই মহিলাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সমস্যা হয়।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleচিকিৎসা নিয়ে ভয়
Next articleমোড়ক উন্মোচিত হল অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার এর লেখা বইয়ের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here