দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা

0
226

বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা থাকবে স্বাভাবিকভাবে, এটাই সবাই ধরে নেয়। তবে সর্বদা এটা সদা সত্য মনে করাও হয়তো সঠিক নয়। কেননা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসায় অনেকগুলো জটিল বিষয় রয়েছে। যেমন, ভালোবাসার মাত্রা। বিয়ের প্রথম দিকে, ভালোবাসার মাত্রা যতটা থাকে সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসার সে মাত্রাটা কমতে থাকে। সন্তান হবার পূর্বে মাত্রাটি এক রকম থাকে এবং পরে অন্য রকম।

অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে এই ভালোবাসার সম্পর্ক চরম মাত্রায় উঠা-নামা করে। বাসার অন্যান্য সদস্যদের (যেমন- শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ) কারণেও ভালোবাসার মাত্রার তারতম্য ঘটে। মোট কথা, ভালোবাসা নামক সাঁকো টিকে কখনও টিকে থাকতে দেখা যায়, আবার কখনও হারিয়ে যায়। এই লুকোচুরি খেলার মধ্য দিয়েই পেড়িয়ে যায় বিবাহিত দুজন মানুষের জীবনের গল্প।

Conjugal love

আমাদের পূর্ব পুরুষদের বিবাহিত জীবনের ভালোবাসার রূপটি ছিলো বড় অদ্ভূত। নানী- দাদীদের অধিকাংশরাই পাত্রের মুখ না দেখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। নানা-দাদারা পাত্রীর প্রতি ভালোবাসা আছে কিনা সেটা বোঝার আগেই আমাদের মামা, চাচা, খালা ও ফুপুরা জন্ম নিয়ে ফেলেছিলেন। তখনকার দিনে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা কিছুটা প্রভু-ভৃত্যের সাথে তুলনা যোগ্য। স্ত্রীরা স্বামীকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন, এর ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ বা ভালোবাসা থাকলেও থাকতে পারে।

এখনকার পুরুষরা হয়তো বলবেন ওটাই ঠিক ছিলো। স্বামীকে ভয় পাওয়া ও শ্রদ্ধা করা উচিত, তাহলে সংসারে ঝামেলা হয়না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখনকার স্বামী-স্ত্রীরা ভালোবাসা ছাড়াই বিবাহিত জীবনের ৫০-৬০ বছর কাটিয়ে দিতেন। মনে মনে ধরেই নিতেন, হয়তো সে আমাকে ভালোবাসে। আবার ভালোবাসা সেটা আবার কি? খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, সংসার করছি, একসাথে থাকছি-এইতো সব। আবার এদের মধ্যেই দেখা যেতো একজনের প্রতি আরেকজনের গভীর টান। যা এ জামানায় খুঁজে পাওয়া দূরূহ। অর্থাৎ তৎকালীন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাও ছিলো ১০০% গ্যারাটি মার্কা স্থায়ী।

বর্তমান যুগের স্বামী-স্ত্রীদের প্রতি তাকানো যাক। সময় যেমন, পাল্টে গেছে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ধরনও তেমনি পাল্টে গেছে। বর্তমান সময়ে এক জোড়া স্বামী স্ত্রীকে যেমন সংসারের সবকিছু নিয়ে হিসাব কষতে হয় তেমনি ভালোবাসায় ঠিক হিসাব ছাড়া পা বাড়ায় না। স্বামী স্ত্রীর জন্য কী করলে, তার ভিত্তিতে স্ত্রীকে যেন স্বামী ভালোবাসে, একইভাবে উল্টোটাও! নিটোল অনাবিল ভালোবাসা কেমন টিভি সিরিয়ালে আর ম্যুভিতেই দুজনকে উপভোগ করে তুষ্ট থাকতে হয়।

আমাদের আশেপাশে এমন কিছু দম্পতি আছে যারা প্রতি নিয়ত ঝগড়া-ঝাঁটি, গালিগালাজ এমনকি মারামারি করতে ব্যস্ত থাকেন। এদের আবার দেখা যায়, খুব সুন্দর পরিপাটি হয়ে একসাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন, সন্তানও জন্ম দিচ্ছেন।

খুবই চিন্তার বিষয় এরা কি আসলে দুজন দুজনকে ভালোবাসে নাকি দুজন দুজনার উপর আক্রোশ উগড়ে দিয়ে আরাম পাবার জন্য থাকে? এদের ভালোবাসার প্রকাশটা খুবই অপরিপক্ক। কেউ কাউকে ঠিক মতো বুঝিয়েই উঠতে পারেন না যে তারা অপরজনকে ভালবাসে। পশু-পাখিরা যেমন তাদের ভালবাসা, খেলাধুলা, রাগ সবকিছুই এক হিংস্রতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে, তাদের ভালোবাসার প্রকাশটিও একই রকম।

এদের কিছু সামাজিক দক্ষতার অভাব আছে বলে মনে হয়। আর যদি ভালোবাসা না-ই থাকে তবে কেন মিছে সংসার নামক গাড়ীটিকে ঠেলতে হবে? একটু থামুন, ভাবুন, গাড়ীটি ঠিক হতে মূলত যে জিনিসটির প্রয়োজন ‘স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা’ সেটিকে মেরামত করুন। গাড়ী আপনা থেকেই চলতে শুরু করবে।

কিছু কিছু দম্পতির ভালোবাসা দেখলে তাঁদের স্বামী-স্ত্রী মনে না হয়ে বরং মা-ছেলে অথবা বাবা-মেয়ের মতো ভালোবাসা মনে হতে পারে। মা যেমন তার শর্তহীন আদর ভালোবাসার ছায়ায় ছেলের দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনি স্ত্রী তার গভীর ও ভারী ভালোবাসারভারে স্বামীকে ন্যুজ্জ করে রাখেন এবং স্ত্রীর কথায় উঠে বসেন, খেতে যান ঘুমাতে যান। বাধ্য ছেলের মতো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন এবং ভীষণভাবে স্ত্রীর নির্ভরশীল থাকেন।

অপরদিকে দেখা যায়, কারণে-অকারণে শিশুর মতো স্বামীর কাছে বায়না ধরছে কিছু কিছু স্ত্রী। মা বাবার সাথে থাকতে সময়ে যত রকম আদর স্নেহ ভালোবাসা পেয়ে তিনি অভ্যস্ত ঠিক একই রকম আদর স্নেহ ভালোবাসাই তিনি স্বামীর কাছ থেকে আদায় করে চলছেন। বিবাহিত জীবনের প্রতিটি বিষয় তিনি স্বামী নামক পিতার আশ্রয় নিয়ে চলতে চান। স্বামীও পরম স্নেহে তার কন্যা সমতুল্য স্ত্রীকে নিয়ে কখনো খুশি, কখনো রাগ আবার কখনো হাঁপিয়ে উঠছেন। হাঁপিয়ে উঠারই কথা, কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন বন্ধুত্বের তেমনি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার। এখানে অন্যকোনো সম্পর্কের ছায়া পড়লে তা সুস্থ কোনো সম্পর্ক বা ভালোবাসা নয়। এবার যারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন, বিবাহিত হয়ে থাকলে একবার ভেবে দেখুন আপনার দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসার কেমিস্ট্রি কি ঠিক আছে? না থাকলে কি করবেন? আমার পরবর্তী লেখাগুলো পড়তে থাকুক। অচিরেই উত্তর পেয়ে যাবেন।

লেখক
তামিমা তানজিন
কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
প্রত্যয় মেডিক্যাল ক্লিনিক


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Previous articleসিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মানসিক রোগ বিভাগের সেবাতথ্য
Next articleসেলফাইটিস: নতুন মানসিক সমস্যা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here