অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা দূর করবেন যেভাবে

0
82

অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ নিয়েই মানুষের জীবন। মানুষের জীবনে প্রতিনিয়তই কোনও না কোনও ঘটে থাকে। কখনো তা হয়ে থাকে আপেক্ষিক। আর সে ঘটনা নিয়ে মানুষের মনে কাজ করে আক্ষেপ। তখন মানুষের মনে হয়, যদি এমনটা না করে এমনটা করতাম। অথবা পূর্বের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আজও হিসেব কষে যায়। এসবকে এক কথায় অতিচিন্তা কিংবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

কিন্তু কথায় আছে, চিন্তাবিহীন কার্য নাকি ডেকে আনে বিপদ। তাই ‘অতিরিক্ত চিন্তা’য় অনেকে মানসিক সমস্যায়ও পড়েন। ‘বেশি চিন্তা’ মন আর শরীরের মধ্যে তৈরি করে ভারসাম্যহীনতা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘অহেতুক দুশ্চিন্তা অনেকটা চক্রের মতো। যত দূর করতে চাইবেন, তত আপনাকে জেঁকে ধরবে। কথায় আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’ মস্তিষ্ক যত অলস বসে থাকে, তত মাথায় জমা হয় অহেতুক চিন্তা। করোনা মহামারির সময়ে বাসায় বসে থাকতে হচ্ছে কমবেশি সবাইকে। আর সে সময়েই মাথায় জমা হচ্ছে হাজারো দুশ্চিন্তা।’

ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের করা এক গবেষণা অনুযায়ী যায়, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ এই কাজ করে থাকেন। ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা কমে আসে ৫২ শতাংশে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এদের অনেকেই মনে করেন অতীত হাতড়ে বেড়ানোর মাধ্যমে তারা নিজের জন্য ভালো কিছু করছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটা উল্টো।

অহেতুক দুশ্চিন্তায় যা হয়

অহেতুক দুশ্চিন্তার সূচনা হতে পারে যেকোনো জায়গা থেকেই। আর তার প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবনে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগে ভুক্তভোগী ব্যক্তির মন ও শরীর সব সময় ‘টেনসন্ড’ থাকে বলে শরীর ও মন যাতে রিলাক্সড থাকে, সেটা চেষ্টা করা উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম করুন অথবা প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট দ্রুত হাঁটুন। দেখবেন আপনার শরীর ও মন কিছুদিন পরে অনেক রিলাক্সড বা শান্ত বোধ করবেন।

সৃজনশীলতার অবক্ষয়: মস্তিষ্কের কিছু অংশ নিষ্ক্রিয় থাকলে মানুষের সৃজনশীলতা বাড়ে। অতিরিক্ত চিন্তায় মগ্ন থাকলে মস্তিষ্কে জং ধরে, সৃষ্টিশীল চিন্তাগুলো ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। এটা ঠিক যে কিছু বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলে নতুন পন্থা বেরিয়ে আসে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত চিন্তা বা দুশ্চিন্তা মানসিকভাবে আপনাকে বদ্ধ করে ফেলে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা কয়েকজন অংশগ্রহণকারীকে ‘এমআরআই’ যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকাবস্থায় কঠিন সহজ মিলিয়ে কিছু ছবি আঁকতে বলেন। যে ছবি আঁকা যত কঠিন, তাতে অংশগ্রহণকারীদের ততই বেশি চিন্তা করতে হয় এবং ছবি আঁকায় তাদের সৃজনশীলতা ততই কমতে থাকে।

কাজের পরিমাণ কমে যায়: অহেতুক দুশ্চিন্তা সবার আগে প্রভাব ফেলে তার দৈনন্দিন কাজের ওপরে। প্রথমে ফাঁকা সময়ে দুশ্চিন্তার উদ্রেক হলেও আস্তে আস্তে ব্যস্ত সময়েও প্রভাব ফেলা শুরু করে। কাজের উৎপাদনশীলতায়ও যার প্রভাব পড়ে।

ঘুম কমে যাওয়া: অহেতুক দুশ্চিন্তার কারণে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে ঘুমে। ঘুমানোর জন্য প্রয়োজন হয় একটি শান্ত মন। আর সে সময়ে যদি দুশ্চিন্তা হানা দেয়, তবে কি আর ঘুম আসে? রাতের ঘুমে বড় প্রভাব ফেলে অহেতুক দুশ্চিন্তা।

অলসতা বেড়ে যাওয়া: দুশ্চিন্তা একবার শুরু হলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। আর সে চিন্তা শেষ না করে কোনো কাজে মন দেয়াও সম্ভব হয় না। ফলে হয়তো ভেবে রেখেছেন এক ঘণ্টা পর কোনো কাজে বসবেন, অহেতুক দুশ্চিন্তা সে কাজকে পিছিয়ে দেবে আরও কয়েক গুণ।

খাওয়া রুচি কমে যাওয়া: মানুষ ভেদে এক্ষেত্রে প্রভাব ভিন্ন। দুশ্চিন্তায় কারও খাওয়া বন্ধ হয়, কারও আবার লাগামহীন হয়ে যায়। খাওয়ার ব্যাপারটা দুশ্চিন্তা থেকে সামান্য অন্যমনস্ক করে যা স্বস্তিদায়ক। আর এসময় মানুষ বেছে নেয় সবচাইতে সুস্বাদু কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাবারটাই। প্রক্রিয়াজাত চর্বি, চিনি ইত্যাদি অস্বাস্থ্যকর উপাদানে ভরপুর খাবারগুলো ‘কমফোর্ট ফুড’ হিসেবে হয়ত একারণেই খ্যাত।

পরিত্রাণের উপায়

কোনো সমস্যা থেকে বের হওয়ার প্রথম ধাপ হলো সমস্যা চিহ্নিত করা। দুশ্চিন্তা করা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু কখন এই দুশ্চিন্তা অহেতুক এবং অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে শিখুন। বারবার একই বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, একই সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করা—এগুলোই অহেতুক দুশ্চিন্তার লক্ষণ।

ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলুন: মনের মধ্যে ক্ষোভ জমা করে রাখার অভ্যাস কখনোই হৃদযন্ত্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ক্ষমা করার পরিবর্তে ক্ষোভ জমা করে রাখলে মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে হৃদ্ররোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ে।

সমস্যার সমাধান খুঁজুন: বারবার একই সমস্যার কথা না চিন্তা করে সমাধানের পথ খুঁজুন। সমস্যার কথা ভেবে কখনো সমাধান আসে না। বরং যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, ভেবে সমাধান নিয়ে ভাবলেই বরং চিন্তামুক্ত হওয়া সহজ। সমস্যা কখনো মানসিক প্রশান্তি আনতে পানে না। তাই সমস্যা থেকে দ্রুত পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে।

নিজের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন: অহেতুক দুশ্চিন্তা নিজের স্বাভাবিক কাজ থেকেই দূরে সরিয়ে দেয় সবাইকে। নিজের কাজেই মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। যে কারণে সবকিছু বাদ দিয়ে পুরোনো কিছুতে ফিরে যান। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, মুভি দেখা, ছবি আঁকা বা বই পড়া; যেসব শখ বহু বছর আগে আপনার ছিল, সেটিতে মনোযোগ দিন কিংবা নতুন করে শুরু করুন। নিজের প্রিয় কাজে ব্যস্ত থাকলে আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে হারানো আত্মবিশ্বাসও ফেরত পাবেন।

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন: অনেক সময়ই অহেতুক দুশ্চিন্তা মানসিক চাপের সৃষ্টি করে, যা থেকে খিটখিটে মেজাজ কিংবা রেগে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। তখন সে রাগ গিয়ে পড়তে পারে নিরীহ কারও ওপর। সে কারণে এ সময়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন। নইলে সামান্য রাগ হতে পারে আপনার অন্য কোনো সময়ের দুশ্চিন্তার কারণ।

অতীতকে অতীতের জায়গায় থাকতে দিন: যখনই মনে হবে অহেতুক চিন্তা নিজের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে ভাবুন, ‘যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।’ অতীতকে চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, ফলে ওসব নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। অতীতকে অতীতের জায়গায় থাকতে দিলেই বরং সবার জন্য ভালো। এই চিন্তা নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করুন, তবেই এই দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া যাবে।

মনে রাখবেন, দুশ্চিন্তা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ। দুশ্চিন্তা করাও দোষের কিছু নয়, কিন্তু এই দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব আপনারই। খেয়াল রাখবেন, দুশ্চিন্তাকে যেন আপনি নিয়ন্ত্রণে রাখেন, দুশ্চিন্তা যেন আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে।

এআরআই

 

যদি কোনও ব্যক্তি অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যায় ভূগে তবে তার উচিত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করা।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

Previous articleঅতিরিক্ত খাবার গ্রহনও একটি ব্যাধি
Next articleবয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের মনোজগৎ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here