অতিচঞ্চলতা (ADHD) রোগের আধুনিক চিকিৎসা

0
117

চঞ্চলতা প্রতিটি শিশুর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই চঞ্চলতা যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সেটিকে বলে ADHD বা অতিচঞ্চলতা রোগ। এটি মস্তিষ্কের একটি বিকাশজনিত সমস্যা, ইংরেজীতে যাকে বলে Neurodevelopmental Disorder।

আজ থেকে বছর দশেক আগেও এই রোগ সম্পর্কে মানুষের খুব বেশি ধারনা ছিলনা। কিন্তু সময় যত এগোচ্ছে, ADHD সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহও তত বাড়ছে। বিশেষত বর্তমানে এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে অভিভাবকদের মনে নানা প্রশ্ন থাকে- চিকিৎসায় কি ADHD সম্পূর্ন ভাল হবে? আমার শিশু কি আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মত জীবনযাপন করতে পারবে?

উত্তর হচ্ছে- পারবে। দ্রুততম সময়ে ADHD নির্নয় করে যদি চিকিৎসার আওতায় আনা যায় তাহলে এই রোগে আক্রান্ত শিশুরাও আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মত ভবিষ্যতে সফল জীবনযাপন করতে পারবে।

চিকিৎসার উদ্দেশ্যঃ ADHD আক্রান্ত শিশুদের যদি সঠিক চিকিৎসা দেয়া না যায় তাহলে পরবর্তীতে এইসকল শিশু পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়া, আচরনগত সমস্যা, অতিচঞ্চলতার কারনে বিভিন্ন দূর্ঘটনার শিকার হওয়াসহ পরিনত বয়সে নানা সামাজিক ও পারিবারিক কলহ, ঘনঘন চাকরি হারানো, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া এবং মাদকাসক্তিসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই অতিচঞ্চলতা রোগের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হল রোগীকে ভবিষ্যত সম্ভাব্য সকল জটিলতা থেকে বাচিয়ে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে সাহায্য করা।

চিকিৎসার প্রকারভেদঃ অন্যান্য মানসিক রোগের মত ADHD রোগের চিকিৎসায়ও ওষুধ এবং সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশন এই দুটোরই ভূমিকা রয়েছে। সেই সাথে বাড়তি সংযোগ হিসেবে আছে খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন।

ওষুধের ভূমিকাঃ ADHD রোগের ওষুধের মধ্যে প্রথম সারির ওষুধের মধ্যে আছে স্টিমুলেন্ট গ্রুপের ওষুধসমূহ যেমন- মিথাইলফেনিডেট, এম্ফিটামিন ইত্যাদি। এর মধ্যে উন্নত বিশ্বে মিথাইলফেনিডেটের ব্যবহার ব্যাপক। কিছুদিন আগ পর্যন্তও এই মিথাইলফেনিডেট আমাদের দেশে পাওয়া যেত না, অন্যদিকে উচ্চমূল্যের কারনে বিদেশী কোম্পানির তৈরীকৃত এই ওষুধ আমাদের দেশের অনেক রোগীর পক্ষেই কেনা সম্ভব হত না। তবে আশার কথা হচ্ছে, খুব সম্প্রতি আমাদের দেশেই মিথাইলফেনিডেট ওষুধটি তৈরী হচ্ছে যার ফলে ADHD রোগের চিকিৎসা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। পাশাপাশি দ্বিতীয় সারির ওষুধ হিসেবে বিভিন্ন নন-স্টিমুলেন্ট যেমন এটোমক্সেটিন, গুয়ানফেসিন ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা যায়।

বয়সের দিক বিবেচনায় পাঁচ বছর এবং তার অধিক বয়েসী শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে তীব্র মাত্রার অসুখে প্রথমেই ওষুধ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে মৃদু ও মধ্যম মাত্রার অসুখে সাইকোথেরাপির কথা প্রথমে বলা হলেও এতে যদি কোন উন্নতি না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সাইকোথেরাপির সাথে ওষুধের ব্যবহার করলে ভাল উন্নতি পাওয়া যায়।

সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশনঃ পাঁচ বছরের নিচের শিশু এবং যেকোন বয়েসী মৃদু মাত্রার ADHD রোগীদের ক্ষেত্রে প্রথমেই সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশনের কথা বলা আছে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম বিষয়টি হচ্ছে রোগীর পরিবারকে এই রোগ সম্পর্কে একটি সহজ ও সঠিক ধারনা (সাইকোএডুকেশন) দেয়া। এরপর ধাপে ধাপে রোগীর পরিবার ও রোগীকে বিভিন্ন সাইকোথেরাপীর আওতায় আনা যেমন- প্যারেন্ট ট্রেনিং প্রোগ্রাম, বিহেভিয়ার মডিফিকেশন থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, সোশ্যাল স্কিল ট্রেনিং ইত্যাদি।

পরিবারের ভূমিকাঃ ADHDর সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশনের দিকে তাকালেই দেখা যায় এই রোগ নিয়ন্ত্রনে পরিবারের ভূমিকা কতখানি। এছাড়াও নিয়মিত ঔষধ সেবন, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে খেয়াল রাখা, সর্বোপরি রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে রাখার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।

খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনঃ কিছু গবেষনায় পাওয়া গেছে যে কৃত্রিম রঙ সংবলিত ও প্যাকেটজাত খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার ইত্যাদি বাচ্চাদের হাইপারএক্টিভিটির সহায়ক যেজন্য অনেক চিকিৎসক বাচ্চাদের এই খাবারগুলো দিতে নিষেধ করেন। কিন্তু সম্প্রতি নতুন কিছু গবেষনায় উঠে এসেছে যে এধরনের খাবারের সাথে সরাসরি বাচ্চাদের হাইপারএক্টিভিটির বিষয়টা বিতর্কিত। যদি ব্যক্তিবিশেষে কোনো শিশুর ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট খাবারের সাথে তার অতিচঞ্চলতার সংযোগ পাওয়া যায় শুধুমাত্র তবেই সেটি বাদ দিতে হবে অন্যথায় একটি পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শারিরীক ব্যায়ামই অতিচঞ্চল শিশুদের জন্য যথেষ্ট।

আধুনিক চিকিৎসাঃ ADHDর আধুনিক চিকিৎসায় সর্বশেষ সংযোজন eTNS (External Trigeminal Nerve Stimulation) যার অর্থ দেহের বাইরে একটি ছোট্ট ডিভাইসের সহায়তায় মস্তিষ্কের ট্রাইজেমিনাল নার্ভকে উদ্দীপনা দেয়া। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের FDA এই ডিভাইসটির অনুমোদন দেয় যা বর্তমানে আমেরিকার প্রায় ৬ মিলিয়ন ADHD আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমরাও এই eTNS er মাধ্যমে আমাদের দেশের অতিচঞ্চল শিশুদের চিকিৎসা দিতে পারব।

কখন ওষুধ বন্ধ করা যাবে? অতিচঞ্চল বাচ্চার অভিভাবকদের মনে সবসময়ই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, তা হল – আমার বাচ্চাকে কি আজীবনই ওষুধ খেতে হবে? এর উত্তর হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘসময় ধরে এমনকি পরিনত বয়সে এসেও ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্র বিবেচনায় ওষুধ বন্ধও করা যেতে পারে। যেমন-

  • যদি ওষুধ চলাকালীন বিগত এক বছর ধরে আপনার শিশুর মধ্যে ADHD রোগের কোনো লক্ষনই আর না থাকে।
  • ওষুধের ডোজ না বাড়ানো স্বত্ত্বেও অর্থাৎ একই ডোজে আপনার শিশুর অবস্থার দিনকে দিন উন্নতি হতে থাকে।
  • ভুলক্রমে কোনো ডোজ বাদ পড়লেও আপনার শিশুর মধ্যে পুনরায় কোন লক্ষন দেখা না যায় এবং,
  • আপনি বুঝতে পারেন যে আপনার সন্তানের মধ্যে যেকোন কাজে মনোনিবেশ করার একটি নতুন ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

তবে সন্তানের এই বিষয়গুলোতে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরও কখনো নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ করবেন না। আপনার পর্যবেক্ষন যাই হোক না কেন, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনার কথাগুলি বলবেন এবং পরবর্তীতে তার পরামর্শেই ওষুধ বন্ধ করবেন।

মনে রাখবেন, আপনার শিশুর অতিচঞ্চলতা কোনো দুষ্টুমি না, আচরনগত সমস্যা বা অবাধ্যতা না, এটি তার ইচ্ছাকৃতও নয়। এটি একটি মানসিক সমস্যা, মস্তিষ্কের রাসায়নিকের কিছু তারতম্য যা অন্যান্য সকল অসুখের মত সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব।

ডা. মাহাবুবা রহমান
রেসিডেন্ট, চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

Previous articleমনোবিদ্যায় ভালবাসা নিয়ে কিছু কথা
Next articleকপালের নিচে ও নাকের গোড়ায় ভারী বা অস্বস্তি অনুভব করছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here