হুমায়ূনের স্মৃতির ভুবন

0
67

পুলিশ অফিসার ফজলুর রহমানের লাশ বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে ভাসছে, রাজাকারেরা তাকে মেরে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে নদীতে; জনমনে আতংক তৈরি করেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ স্বামীর জুতো দেখে সনাক্ত করেছেন তিনি শহীদ পুলিশ অফিসার। এই নিয়ে লেখালেখির ভুবনে পা রাখলেন তার বড় ছেলে, বিরাট পরিবারের কতা হুমায়ূন আহমেদ।

ভয়, ভীতি আর উদ্বেগ সঙ্গী হলো ছেলেটির। অসাধারণ মেধাবী, বলতে গেলেন প্রথম সারির মানুষ এই লোকটি তার সারা জীবনেও এই রোগগুলোর হাত থেকে বেরুতে পারেননি। রোগকে করেছেন সাথী, লিখে গেছেন সেসব নিয়ে পাতার পর পাতা। মিসির আলীর জাদুর জগতে কী আছে? ভয় পাওয়া মেয়ে হুমায়ূনের ভাষায় যাকে ‘নিশিতে পেয়েছে’ বলেন, তাকে ভালো করে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের একজন পাট টাইম টিচার।

আরেক কিংবদন্তী চরিত্র হিমু নিজেই তো আধিভৌতিক জগতে বাস করে। তার কল্পনায় নদী আছে, নাম ময়ুরাক্ষী। যখন, তখন; যেখানে, সেখানে সে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ভালো না লাগলে অবশ্য হিমুর ডিকশনারিতে ভালো না লাগা বলে কোনো শব্দ নেই, সে জগতের আনন্দময়তার মধ্যে বাস করে; যেকোনো বাজে পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। সেখানেও সে হাজির করতে পারে প্রিয় নদীকে।

নতুন একটি মতবাদ সে হাজির করে বাবার সূত্রে; যার লক্ষ্য ছিল ছেলেকে তিনি মহাপুরুষ বানাবেন। সেজন্য নাম রেখেছেন হিমালয়। অথচ হিমালয় ২৯ হাজার ফিটেরও বেশি। সারা বছর বরফের হিমবাহে ঢাকা থাকে। সেগুলোর এক একটি এত বড় যে একটিই বিরাট ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর জন্ম দিয়েছে। যেমন গঙ্গোত্রী নামের হিমবাহ থেকে গঙ্গা ও আমাদের পদ্মার জন্ম। পবিত্রতম নদী বিশ্বের ধমপ্রাণ হিন্দুদের কাছে। তারা গঙ্গাস্নান করেন, পূজোতে ব্যবহার করেন গঙ্গার পবিত্র জল। এসব লেখা আছে বইয়ের পাতায়, পাতায়।

তারপরও হিমুর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ে, সাধনার জন্য। পকেট নেই তাতে। কেননা, টাকা পয়সার লোভ হিমুদের থাকতে নেই। হিমুরা আছে এখন পুরো বাংলাদেশ, ভারত এবং মাকিন যুক্তরাষ্ট্রেও। তারা হিমু পরিবহন গড়েছেন। নিয়ম করে নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন নামের আজব লোকটির কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঘ নিবেদন করেন। বিশ্বকে বাঁচাতে গাছ রোপন করেন।

অনেক দূর থেকে তাদের প্রতি ভালোবাসার, প্রীতির ফুল ছড়িয়ে দেন লেখক নিজে। যার কাছে লেখা ছিল আরাধনার মতো। সন্তান জন্মের, অভাবের, সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল লেখা, কেবলই তার রোল টানা খাতা আর বলপয়েন্ট কলম। লোকটি কী চেয়েছিল তা তিনি নিজেও জানতেন না। মেধাকে ব্যবহারের, দেশকে, সংস্কৃতিকে ভালোবাসার আদশ উদাহরণ হয়ে আছেন তিনি।

বয়াতি কুদ্দুস নামের ময়মনসিংহের এক গ্রামীণ লোক গায়ক, লেখাপড়ায় যে ক অক্ষর গোমাংস; তাকে দিয়ে গাওয়ালেন নিজের লেখা গীতা‘খোকা, খুকু আন্ডা বাচ্চা শোনো দিয়া মন, স্কুলে তো যাইতে হবে হইছে নিধারণ।’ এরপরই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার জোয়ার এলো। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে যায় ওয়ান টু ফাইভের বিদ্যাজন করতে।

বিনা পয়সায় শেখে একেবারে গরীবের সন্তানটিও সবচেয়ে ভালোমানের বইতে। সে বই এতই ভালো যে, সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে ধনী পরিবারের সন্তানেরও সেগুলো না পড়ে উপায় নেই। প্রাক প্রাথমিকের একটি মাত্র বই আছে। বাংলাদেশ সরকারের তৈরি বইটিতে সবার জন্যই ছবি আঁকার সুবিধা আছে, বিদ্যাক্ষর শেখার অনন্যতায় ভরা এই বই।

আরো কত কীতি আছে এই জাদুকরের। লোক গানের প্রতি খুব ভালোবাসা ছিল তার। খুব ভালো গান করেন, প্রকৃতিদত্ত গায়িকা এমন একটি অবিশ্বাস্য মেধাবী মেয়েকে বিয়ে করলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনিকে ফেলে। এরপর তিনি ঢুকে পড়লেন তার হিমু, মিসির আলী, অয়োময়ের ছোট মীজা, নান্দাইলের ইউনূস খুনীর জগতে। তাকে কেউই পান না। প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের রাগ তার কানে ঢোকে না। ফলে মহাবিপদে, মানসম্মান নিয়ে আর বাঁচার মতো অবস্থাতেই পড়ে গেলেন তার পরের ভাই, আরেক মহাবিস্ময় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আলো করে দেওয়া ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি ও কাটুনিষ্ট আহসান হাবীব কিছুই করতে পারেন না হুমায়ূনের বিপক্ষে। কারণ স্ট্রোকে বিপযস্ত মা আয়েশা ফয়েজ তার এই বড় ছেলেটিকে আগলে নিয়েছেন। সবাইকে আঙ্গুল দেখিয়ে মায়ের সঙ্গে অতি ঘনিষ্টভাবে আলাপ, পরামর্শ ও নানা কাজে ব্যস্ত তার আদরের দুলাল।

কেন সে এমন হলো? কী তাকে নিয়ে গেল মানসম্মানের শেষ সীমানায়? এই হুমায়ূনই যে প্রথম তুলে নিয়ে এলেন সিলেটের জমিদার ও গীতিকার, গায়ক হাসন রাজাকে, তার গানের ভুবনে। সেসব গান নিজেই গাওয়ালেন সেলিম চৌধুরীকে দিয়ে তার নাটকে। গান যে বড় ভালোবাসে সে। ‘লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি বালা নাই আমার। কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার?’ হাসন রাজার এই গান আজও বাজে। জীবনের তাগিদে সেলিম এখন লন্ডনে। আর তার নায়ক হুমায়ূন নামের অবিশ্বাস্য মানুষটি ছেলে নুহাশের নামে গড়া বিরাট বাগানের ছোট্ট কবরে। কেমন লাগে? অথচ গতকাল তার জন্মদিন ছিল।

ওমর শাহেদ, ১৩ নভেম্বর, ২০২১।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা
Next articleগবেষণায় এগিয়ে আসতে হবে : বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here