শিশুর সঞ্চয় অভ্যাস গড়ে তোলার উপায়

0
31

শৈশবে আমাদের সব ভাই-বোনদের প্রতি বছর নানাভাই একটি করে মাটির ব্যাংক উপহার দিতেন। কারো ব্যাংক ছিলো মাটির আম, মাটির কাঁঠাল কারো বা অন্য কোনো রঙিন ফল। ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা পেলে প্রায়দিনই ব্যাংকে ফেলতাম আর ৫০ পয়সা পাওয়া মানে সেদিন ঈদের খুশি। তখনো ১ টাকার পয়সা বাজারে আসেনি। ঈদের সালামির টাকাও জমানো হত সেই ব্যাংকে। বছর শেষে মাটির ব্যাংক ভেঙে দেখা হত কার কত জমেছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের সময় নানাবাসায় চড়ুইভাতির জন্য আমাদের জমানো টাকা থেকে ৫/১০ টাকা চাদা ধরা হত, যদিও পুরো খরচটা নানাভাই-ই দিতেন কিন্তু আমাদের সব ভাইবোনদের এই ছোট্ট অবদান রাখার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। 

আমরা অনেক বাবা-মাই ভাবি যে, আমাদের সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে অনেক তফাৎ! এখনকার বাচ্চারা হাই টেক তাই ট্যাব ছাড়া কিছুই বোঝেনা। বাবা-মা হিসেবে তাহলে আমাদের সময়ের কোনো ভাল অভ্যাস তাদের মধ্যে যেন গড়ে উঠে সে চেষ্টা করা যাক!

কেনো সঞ্চয় গুরুত্বপূর্ণ: 

অর্থ সঞ্চয় একটি অভ্যাস যা গড়ে উঠতে সময় লাগে। অনেকে ১০/১২ বছর চাকরি/ ব্যাবসা করার পরও দেখা যায় ১ টাকাও সঞ্চয় নেই। অনেকেই মনে করি, “বর্তমানকে উপভোগ করাই জীবন। বিপদ এলে ঠিকি টাকার বাবস্থা হবে। অনেকে আবার ঋণ করে ঘি খেতে বিশ্বাসী। অনেকে ভাবি, বাপ-দাদার অঢেল আছে, আমার তাই সঞ্চয় প্রয়োজন নেই। ওসব কিপটামি আমাকে দিয়ে হবেনা!” কিন্তু বসে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। একটি শিশুর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সঞ্চয়ের পাঠ শেখানোর মাধ্যমে ভাল আর্থিক অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব যা সারাজীবন স্থায়ী হতে পারে। বাচ্চাদের অর্থ ব্যবস্থাপনার ধারণা, মূল্য এবং গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করা স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিগত আর্থিক সাফল্যের জন্ম দিতে পারে। অর্থ সঞ্চয় জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সম্পদ তৈরি করতে সহায়তা করে। এটি আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা প্রদান করে। অর্থ সঞ্চয় করে আপনি অপচয় রোধ করতে পারেন। ঋণ এড়াতে পারেন, যা আপনাকে মানসিক চাপ মুক্ত রেখে জরুরী পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসী রাখে। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা পরবর্তী প্রজন্মের জীবন যাত্রার মানকে প্রভাবিত করে যা বাক্তির শিক্ষা, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্বে পার্থক্য তৈরি করে। মাত্র ১৫ টাকা দিয়ে এই মুহূর্তে একটি চিপস না খেয়ে যে এরকম অনেকগুলো ১৫ টাকা জমিয়ে বড় কিছু পাওয়া সম্ভব এই অনুভূতি আপনার সন্তানকে ধৈর্যশীল হতে সাহায্য করে। কথায় বলে “সবুরে মেওয়া ফলে”। এতে শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি তৈরি হয়। তবে আপনি নিজে যদি বিশ্বাস করেন যে, “সঞ্চয় যখন করার এমনিতেই করবে, এসব আবার শেখানোর কি আছে!” তবে হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি, সঞ্চয়বিহিন হয়ে এই যুগে আপনার সন্তান লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে তো!

সঞ্চয় নাকি কৃপণতা:

আধুনিক যুগে অনেকেই ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে কেনাকাটা করে একটা মান সম্পন্ন জীবন যাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। কখনো প্রেস্টিজ ইস্যুর কারণে আত্মীয়-বন্ধুদের দেখানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ফেলছি। নিজের অজান্তেই বাড়াচ্ছি ঋণের বোঝা। ইংরেজি প্রবাদ আছে “Cut your coat according to your cloth”। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো মানে কৃপণতা নয়। প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমাতে হবে। অল্পে তুষ্ট হতে পারা জীবন বোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একি জিনিস ১০ টা থাকার পরও যদি আবার কিনতে নিজেকে আটকাতে না পারি তবে আমাকে কৃপণ হওয়াটাই শিখতে হবে। 

বাড়ির কাজে পারিশ্রমিক: 

আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব সার্টিফাইড পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্টস (এআইসিপিএ)-এর জরিপ অনুসারে, দুই-তৃতীয়াংশ অভিভাবক বলেছেন যে তারা ২০১৯ সালে তাদের সন্তানদের ভাতা প্রদান করেছে। পাঁচ সপ্তাহের কাজের উপর ভিত্তি করে বাচ্চারা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩০ ডলার উপার্জন করেছিল। আমাদের দেশেও অনেক বাবা-মাই এখন বাচ্চাদেরকে ঘরের কাজে উৎসাহিত করার জন্য অর্থের অংক নির্ধারণ করে দেন। যেমন: গাছে পানি দেয়া-১০/, ঝাড়ু-২০/, কাপড় ধোয়া-৫০ ইত্যাদি। এতে শিশু পরিবার থেকে শেখে যে, অর্থ উপার্জন কোনো সহজ কাজ নয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, অর্থ উপার্জন যেন শিশুর নেশায় পরিণত না হয়। তার আসল কাজ হল পড়ালেখা করা সেটাই মনে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুর হাতে সরাসরি টাকা না দিয়ে একটা হিসেব রেখে মাস শেষে ওই টাকা দিয়ে তারই কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস কিম্বা শখের জিনিস কিনে দেয়া যেতে পারে। এমন যেন না হয় যে, শিশু বলল, “আমার টাকা আমি যা খুশি তাই করব, অন্যে বাধা দেবার কে!” মনে রাখতে হবে অল্প বয়সে ঘরে কিম্বা বাইরের যে কোন উপার্জনই শিশুকে বিপথগামী করতে পারে। 

শিশুকে কিভাবে সঞ্চয় শেখাতে পারি:

প্রথম ধাপ হল সঞ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া।

১। শখ বনাম প্রয়োজনীয়তা:

বাচ্চাদের সঞ্চয়ের মূল্য শেখানোর প্রথম ধাপ হল চাওয়া এবং চাহিদার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখা। মৌলিক বিষয়গুলো যেমন: খাবার, বাসস্থান, পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা খাতে খরচের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলুন। ক্যান্ডি থেকে শুরু করে ডিজাইনার স্নিকার, সাইকেল, স্মার্টফোন, ট্যাব সবই শিশু চাইতে পারে। এই মুহূর্তে ক্রমানুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট করতে বলুন। 

২। সঞ্চয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ:

শিশুর কাছে সঞ্চয় করা অর্থহীন মনে হতে পারে। কেনো সঞ্চয় করতে হবে তা জানলে তাদের লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে। লক্ষ্য হতে পারে টিফিনের টাকা জমিয়ে মাস শেষে একটি প্রিয় খেলনা, কিম্বা বছর শেষে একটি বই-এর সেল্ফ কেনা। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে ব্যাংক ভেঙে দেখা যেতে পারে কত টাকা জমেছে।

৩। সংরক্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা:

ছোট বাচ্চারা তাদের সঞ্চয়গুলো শখের বসে পিগি ব্যাংক/ মাটি/ প্লাস্টিক/ কাঠের কিম্বা খেলনা সুন্দর কোনো ব্যাংকে রাখতে পারে। বাচ্চার নামে বাসার কাছে কোনো ব্যাংকে সঞ্চয় হিসাব খুলতে পারেন। করতে পারেন পছন্দ মত জীবন বীমা/ স্বাস্থ্য বীমা। এভাবে তারা দেখতে পাবে কিভাবে তাদের সঞ্চয় বেড়ে লক্ষ্যের অগ্রগতি হচ্ছে। শিশুর নামে ফলজ কিম্বা বনোজ গাছ লাগানোও হতে পারে একটি সঞ্চয়ের উপায়।

৪। সঞ্চয় প্রণোদনা:

বাচ্চাদের কখনো সঞ্চয় করতে সমস্যা হতে পারে আর তখন আপনি প্রচেষ্টা বাড়িয়ে তুলতে পারেন। যদি সঞ্চয়ের লক্ষ্যের পরিমাণ বড় অংক হয়, যেমন: আগামী ৬ মাস সঞ্চয় করে একটি সাইকেল কেনার পরিকল্পনা হচ্ছে। তখন সেখানে আপনি কিছু যোগ করে দিলে আপনার বাচ্চা একটি সঞ্চয়ের মাইলফলকে পৌঁছাতে পারবে।

৫। বাবা-মার ঋণদাতা হয়ে উঠা:

যদি আপনার সন্তান সঞ্চয় করার জন্য অধৈর্য্য হয়ে উঠে, তাহলে আপনি ঋণদাতা হয়ে উঠতে পারেন। যেমন: আপনার সন্তান একটি পেন্সিল বক্স কিনতে চাচ্ছে যার দাম ১০০ টাকা। কিন্তু তার এ মাসের সঞ্চয় হয়েছে ৯০ টাকা। এক্ষেত্রে আপনি ১০ টাকা “ঋণ” দিতে পারেন এই শর্তে যে আপনার প্রদত্ত মাসিক ভাতা থেকে পরের মাসে ১০ টাকা ফেরত দিতে হবে। আর নাহলে পছন্দের জিনিসটি তাকে পরের মাসে কিনতে হবে। আপনি যে শিক্ষাটি শেখাতে চান তা হল, “সঞ্চয়ের লক্ষ্যপুরণ বিলম্বিত হলেও তা পরিতৃপ্তি আনে। কিন্তু পছন্দের জিনিসটির দাম বেশি হলে অপেক্ষা করতে হবে।” 

৬। বাবা-মার নিজের একটি ভাল উদাহরণ হয়ে উঠা:

সঞ্চয়ী মৌমাছি আর পিপড়ার গল্প যেন আমরা ভুলে না যাই। সঞ্চয় যে হঠাৎ নিজের কিম্বা অন্যের বিপদে কতটা সহায়ক সেটার বাস্তব অভিজ্ঞতা সন্তানকে জানান। পরিবারের সবার জন্য “দানবাক্স” হিসেবেও একটি সঞ্চয় পদ্ধতি রাখা যেতে পারে। এতে প্রতিদিন/ সপ্তাহে ৫/১০/২০ টাকা যে যা পারে রাখবে আর মাস/ বছর শেষে পুরো টাকা বিপদগ্রস্ত, অভাবী কাউকে প্রদান করা হবে। এ থেকে আপনার সন্তান সঞ্চয় করাও শিখবে এবং পরোপকারী ও দয়ালু মনোভাব তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে সঞ্চয় করতে গিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশা যেন না হয়ে যায়। আপনার বর্তমান সঞ্চয়ের উপর যাকাত ফরয হলে সেই হিসেবও সন্তানকে শিখতে সাহায্য করুন।

পরিশেষে, কারো মাসের বাজেট ৫০ হাজার, কিম্বা ৫০ কোটি যাই হোক না কেনো নতুন বছরে আপনার সন্তানের জন্য একটি সঞ্চয়ী ব্যাংক হতে পারে একটি ভাল উপহার। মনে রাখবেন পরিবার থেকেই শিশুরা শেখে। তাই আমরা যেন নিজেরাই সঞ্চয়ের একটি ভাল উদাহরণ হয়ে উঠতে পারি। 

লিখেছেন ফারজানা ফাতেমা (রুমী)

মনোবিজ্ঞানী, “শৈশবকালীন প্রতিকূলতা ও নিউরো ইমেজিং স্টাডি বাংলাদেশ”, আইসিডিডিআর, বি। আজীবন সদস্য- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleধর্ষকের মন
Next articleমন খুলে হাসুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here