লেখাপড়ার কথা মনে হলেই আমার ভয় লাগে এবং মনে হয় লেখাপড়া অনেক কঠিন

সমস্যা:
স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমার নাম কবির হোসেন। আমি একজন ছাত্র। আমার বয়স ২১ বছর। আমার সমস্যা হলো আমি লেখাপড়া করতে পারি না। অথচ স্কুলে আমি সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিলাম। স্কুলের স্যার এবং এলাকার লোকজন আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করতো। কিন্তু ২০১২ সালে এস.এস.সি পরীক্ষার অাগে লেখাপড়া নিয়ে হঠাৎ করে আমি একটা চাপের মধ্যে পড়ে যাই এবং আমার মনে হয়েছিল আমি তো কিছুই পারি না, আমি কিভাবে এস.এস.সি পরীক্ষা দিবো, আমার আরও মনে হয়েছিল আমি পরীক্ষায় ফেইল করব। আমি এত চাপের মধ্যে পড়ি যে, আমাদের আগের ব্যাচের যেকোনো ছাত্রকে সামনে পেলে জিজ্ঞেস করতাম “ভাই পরীক্ষার প্রশ্ন কি অনেক কঠিন হয়, বানিয়ে লিখলে কি পাশ করতে পারবো?” যদি বলত প্রশ্ন সহজই হয়, তাহলে আমি একটু শান্তি পেতাম। তারপর একটু পরে আবার আগের মতো মানুষকে জিজ্ঞেগ করতাম। অর্থাৎ সারাক্ষণ আমার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করতো। তখন আমি এতটা অস্থিরতা অনুভব করছিরাম যে, আমার মনে হতো আমি পাগল হয়ে যাব। অামার মনে হতো লেখাপড়ার থেকে কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। এর চেয়ে অনেক ভাল মরে যাওয়া। আর লেখাপড়া ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। তখন অামি ঘুমাতেও পারতাম না। ঘুমালে শুধু লেখাপড়া নিয়ে একই স্বপ্ন বারবার দেখতাম, জেগে উঠতাম এবং আবার ঘুমাতাম। আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, এস.এস.সি পরীক্ষা দেয়ার মতো কোনো ক্ষমতা আমার ছিল না। তবুও পরীক্ষাটা দেয়ার জন্য স্কুলের সকল স্যার এবং পরিবারের সবাই আমাকে অনেক সাহায্য করেন। কিন্তু কিভাবে যে কলম ধরে খাতায় লিখব তাও আমি বুঝতে পারছিলাম না। তবুও কোনো রকমে এস.এস.সি পরীক্ষাটা দিলাম। এস.এস.সি তে রেজাল্ট অাসে জিপিএ ৪.৫। এর কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হয়েছিলাম। তাই বাবা-মা আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেন। কিছুদিন কলেজে ক্লাস করেছিলাম। তারপর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। কারণ যখন ক্লাস করছিলাম তখন আমার মনে হতো এগুলো আমি কিভাবে পড়ব। অাগে থেকেই আমার মাথার ভেতর অনেক চাপ ঢুকে যায়। তথচ আমি কোনো চাপ নিতে চাইনা এবং কেউ আমাকে কোনো চাপ দেয়ও না। কিন্তু তবুও সারাক্ষণ আমার মাথার ভেতর শুধু এই চিন্তাগুলোই থাকে এবং আমার মন খারাপ থাকে। তখন অার কোনোকিছু করার মতো কোনো ক্ষমতা আমার থাকে না। সারাক্ষণ শুধু শুয়ে থাকি এবং লেখাপড়ার চাপ এবং ভয়াবহতা নিয়ে মাথার মধ্যে গভীর চিন্তা অাসতে থাকে। তাই এসব কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কলেজ থেকে চলে এসেছি। এ জন্য পরিবারের সবাই আমার উপর অনেক রাগ। কিন্তু কেন চলে এসেছি তা কেউ বুঝে না। তারপর এক বছর পড়াশোনা বন্ধ দিয়ে এর পরের বছর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছি যাতে কলেজে কম যেতে হয়। কারণ ক্লাস করতে গেলেই আমার সমস্যা হতো। ক্লাসে স্যার যখন কোনো বাড়ির কাজ দেয় তখন আমার মনে হতো আমার উপর অনেক চাপ দেওয়া হয়েছে, এগুলো অামি কিভাবে করব, অামি পারবনা। এই ভয়ে দুই বছরের মধ্যে এক মাসও আমি ক্লাস করিনি। শুধু ফাইনাল পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। তাই কোনো রকমে জিপিএ ৩.২৫ পেয়ে এইচ.এস.সি পাশ করেছি। কিন্তু এ বছর আমার মা-বাবা আমাকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করেছেন। এক সপ্তাহ ক্লাস করার পরই ভেতরে অাবার অাগের মতো চাপ ঢুকে যায় এবং অস্থিরতা শুরু হয়। ভার্সিটিতে ক্লাসমেটসরা সবাই কত মজা করে, কিন্তু আমি পারিনা। কারণ সারাক্ষণ আমার মনে হয় আমি অনেক খারাপ ছাত্র, আমি কিছুই পারি না। সবসময় মনে মনে শুধু এসব চিন্তাই অাসতে থাকে এবং আমার মন খারাপ থাকে। তাই কারো সাথে মিশতেও পারিনা। যেখানেই যাই মনে মনে শুধু লেখাপড়া নিয়েই এসব চিন্তা করতে থাকি। অনেক অসহ্য বোধ করি। কারণ আমার স্মৃতি থেকে লেখাপড়ার এসব চিন্তা আমি ভুলতেই পারিনা। সারাদিন শুধু শুয়ে থাকি। অার লেখাপড়ার ভয়াবহতা নিয়ে গভীর চাপ এবং ভয় মাথার মধ্যে অাসতে থাকে। ঘুম মোটামুটি হয়। হাত-পা সবকিছু ঠিকই অাছে, কিন্তু কোনোকিছু করার মতো কোনো ক্ষমতা আমার নেই। কি করলে কি হবে কোনোকিছু বুঝতে পারছি
না। স্মৃতিশক্তি, খেয়ালশক্তি এবং মনোযোগ অনেক কমে গেছে। আর আমার মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই এসব কারণে আবারও আগে থেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে এসেছি। বারবার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসায় এখন আমি পরিবার থেকেও অনেক লাঞ্চিত। কারণ পরিবারের সবাই বলে লেখাপড়া করতে নাকি আমার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি নাকি ভান করি। কিন্তু বিশ্বাস করেন স্যার, পড়াশোনা করতে আমার অনেক ইচ্ছা হয়। পড়াশোনার প্রতি আমার অনেক Interest ছিল। সারাদিনই আমি পড়াশোনা করতাম। কিন্তু এখন পারিনা। ২০১২ সালের অাগে কখনও আমার এ রকম কোনো সমস্যা ছিলনা। স্যার আমার সমস্যা কি সমাধান করা সম্ভব?? অামি কি আবার লেখাপড়া করে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে পারব এবং সুন্দর একটা জীবন ফিরে পাব???
 
পরামর্শ:
আপনার মাঝে কতগুলো সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন-
১। বাধ্যতাধর্মী চিন্তা (Obsessive thought)- “লেখাপড়া থেকে কঠিন পৃথিবীতে আর কিছু নেই”… ইত্যাদি
২। এক কাজ বার বার করবার প্রবণতা (Compulsive act)-  বার বার জিজ্ঞাসা করা।
৩। অস্হিরতা।
৪। এড়িয়ে চলা (Avoidance) – কলেজে না যাওয়া, পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া।
৫। নিজকে নিম্নমানসম্পন্ন মনে করা (Inferiority complexity)- “সারাক্ষণ আমার মনে হয় আমি অনেক খারাপ ছাত্র, আমি কিছুই পারি না।”
আপনি যদি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার আওতায় আসেন তবে আশা করি আপনি এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। প্রথমে আপনার কিছু ঔষধের প্রয়োজন রয়েছে। ঔষধ আপনাকে চিন্তা ও  এক কাজ বার বার করবার প্রবণতার সমস্যার উন্নতি করবে। সেই সাথে সাইকোথেরাপী (কাউন্সেলিং) -এর প্রয়োজন। কাউন্সেলিং আপনার অস্হিরতা,  এড়িয়ে চলা, নিজেকে নিম্নমানসম্পন্ন মনে করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করবে। আপনার মনোবল বাড়বে এবং আপনি সুস্থ জীবনে ফিরে আবার লেখাপড়া করে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন। সেই সাথে সুন্দর একটা জীবনও ফিরে পাবেন।
পরামর্শ দিচ্ছেন,
প্রফেসর ডা. ঝুনু শামসুন্নাহার


দৃষ্টি আকর্ষণ- মনেরখবর.কম এর প্রশ্ন-উত্তর বিভাগে, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি সহ মন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আপনার কোনো জানার থাকলে বা প্রশ্ন থাকলে বা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দরকার হলে question@www.monerkhabor.com এই ইমেলের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন।

Previous articleশুদ্ধ ভালোবাসা মানুষকে পবিত্র রাখে: সংগীতশিল্পী সানী জুবায়ের
Next articleআমার সমস্যা হলো অতিরিক্ত পরিস্কার পরিছন্নতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here