রাগ বশে আনবেন যেভাবে

রাগ বশে আনবেন যেভাবে

একটা কথা প্রায়ই আমরা দেখি বা শুনি যে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। একদল মানুষ এই কথাটা আক্ষরিকভাবে মেনে নেন এবং জয়ী হতে রাগ গিলে ফেলেন।

আরেক দল আছেন যারা এই কথাটা তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেন এবং রাগারাগি করাটাকে ব্যক্তিত্বের পরিচয় মনে করেন। তারা নিজেদের চারপাশে আধিপত্য বজায় রাখতে রাগটাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।

আর আরেক দল মানুষ আছেন যারা রাগ হলে খুব সুন্দরভাবে রাগের বিষয়টা প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে যেন রাগের বিষয়টা না ঘটে তার ব্যবস্থাও করতে পারেন অথবা নিজের সঙ্গে হওয়া কোনো অন্যায়ের সুন্দর ভাবে প্রতিবাদ করতে পারেন। এই রকম ভাবে রাগ হওয়াটা বরং তাদের জয়ী করে তোলে।

সুতরাং রেগে গেলে হেরে যাওয়া নয় বরং রাগ সঠিকভাবে প্রকাশ করল কিনা সেটা দিয়ে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয়। কারণ জীবনে কখনো রেগে যান নাই এরকম মানুষের দেখা পাওয়া অসম্ভবই প্রায়। রাগ একটি সার্বজনীন অনুভূতি, এই অনুভূতির দেখা পাওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় না।

সমস্যাটা হচ্ছে কে, কীভাবে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখান, কতটুকু রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সেটা নিয়ে। রাগ অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করায় যেমন সমস্যা তেমনি রাগকে প্রকাশ না করে পুষে রাখাও সমস্যা তৈরি করে। রাগ প্রকাশ না করলে অথবা রাগের অস্তিত্ব না স্বীকার করলে যথাযথ প্রতিবাদও সম্ভব হয় না।

তাই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায়গুলো এবং সঠিকভাবে প্রকাশ করা শেখা খুব প্রয়োজন। আর এই নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো শেখার নামই অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট থেরাপি বা রাগ নিয়ন্ত্রণ থেরাপি। এই থেরাপি আসলে কোনো ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট প্যাকেজ নয় বরং বিভিন্ন মানসিক কৌশলের সমষ্টি। যেগুলোর লক্ষ হচ্ছে রাগ নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করতে শেখা। যাতে ব্যক্তির জীবনে সেটা কোনো সমস্যা না তৈরি করে।

এই কৌশলগুলো শেখার জন্য অনেক রকমের ব্যবস্থাই করা যেতে পারে। তাই এই থেরাপি হতে পারে একজন ব্যক্তি একজন থেরাপিস্ট এরকম ব্যবস্থায় আবার দলগতভাবেও। এটার সেশন সংখ্যাও নির্দিষ্ট না হয়ে ব্যক্তি বিশেষে প্রয়োজন অনুযায়ী হয়ে থাকে।

সময়ের বিষয়টাও থাকে ব্যক্তির ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী সেটা ছয় সেশনও হতে পারে, আবার বারো সেশনও লাগতে পারে। সরাসরি সেশন এবং অনলাইন ভিডিও কোচিং, টেলিকনসালটেশন অর্থাৎ ফোনের মাধ্যমে শেখানো সেরকমও হতে পারে।

বিভিন্ন রকম মানসিক চর্চা যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ার টেকনিক, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখা, তাড়না নিয়ন্ত্রণ শেখা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল শেখা, অ্যাসারটিভ টেকনিক প্রয়োগ করা যায় রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল আয়ত্ত করতে।

মূল উদ্দেশ্য থাকে রাগের অস্তিত্বকে চিনতে শেখা, রাগের ফলে শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনকে শেখা, রাগের কারণে আচরণ ব্যক্তির জীবনে কী কী নেতিবাচক প্রভাব আনছে সেটা শেখা এবং সেই আচরণগুলোকে বাদ দিয়ে ইতিবাচকভাবে রাগের প্রকাশ করতে শেখা।

কখন প্রয়োজন হয় এই থেরাপি

যখন দেখা যায় রাগের কারণে কারো ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত জীবনে খারাপ প্রভাব পড়ছে, সম্পর্কের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে, ব্যক্তির নিজের মানসিক অবস্থায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে তখন এই থেরাপি নিতে হয়।

রেগে যাওয়া বলতে আমাদের মনে আসে হৈ চৈ, চিৎকার, চেচামেচি, ভাংচুর এরকম। কিন্তু বিপরীতটাও হতে পারে। অনেকেই আছেন রেগে গেলে-

অনেকে চুপ করে থাকেন। একা একা রাগের বশে নিজের মনে গজরান। অনেকে আক্রমণাত্মক কৌতুক, বিদ্রুপ, কটাক্ষ দিয়ে রাগ মেটান। এক জায়গায় রেগে গিয়ে অন্যের ওপর রাগটার প্রকাশ করেন। সাধারণত এটা সবলের সঙ্গে রাগ করে দুর্বলের ওপর মেটান। অফিসে বসকে কিছু বলতে না পেরে বাসায় নিজের সন্তানকে চড়, থাপ্পর মেরে রাগ প্রকাশ করেন।

রাগের বশবর্তী হয়ে যার ওপর রাগ তার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার করেন। নিজের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন যেমন হাত কাটা, ধূমপান-মদ্যপান করা, না খাওয়া বা খুব বেশি খাওয়া এরকম উপায় বেছে নেন। এরকম ক্ষেত্রগুলোতেও রাগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা শেখা প্রয়োজন।

কী কী শেখানো হয় এই থেরাপিতে

পূর্বেই যেমন বলা হয়েছে যে রাগকে চিনতে শেখানো হয়, রাগের ফলে শারীরিক মানসিক পরিবর্তনগুলো চিনতে শেখানো হয়। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য- রিলাক্সেশন, জার্নালিং (কখন কোন পরিস্থিতিতে রাগ উঠল, কী

আচরণ হলো, আচরণের প্রভাব এগুলো লেখার অভ্যাস করা), আবেগ নিয়ন্ত্রণ। সামাজিক দক্ষতা, সম্পর্কের উন্নয়নের কৌশল, ব্যক্তির নিজের ওপর দৃষ্টিপাত এই বিষয়গুলো শেখানো হয়।

পরিশেষে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন নয় বরং রেগে গিয়ে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে হেরে গেলেন এটাই এই থেরাপির মূলমন্ত্র।

ডা. সৃজনী আহমেদ

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ।

Previous articleডা. গোপাল শংকর এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী
Next articleমস্তিষ্কে মাদকের প্রভাব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here