মানসিক স্বাস্থ্য একটি সামাজিক বিষয়, একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়

0
20
মানসিক স্বাস্থ্য একটি সামাজিক বিষয়, একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়

ডা পঞ্চানন আচার্য্য
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি শুনলেই মনে যে ভাবনার উদয় হয় সেটি একটি শারীরিক বিষয়, আর সুস্বাস্থ্য বলতে বুঝায় নিরোগ একটি শরীর। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে অনুমোদিত সংজ্ঞা আছে সেখানে বলা হচ্ছে- স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করাকেই বুঝায়, যেখানে রোগ থাকা বা না থাকা কোন বিষয় না। এই সংজ্ঞা অনুসারে স্বাস্থ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মানসিক স্বাস্থ্য। চলুন, এই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টা অত্যন্ত সংক্ষেপে বুঝতে চেষ্টা করা যাক।

স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল স্বাস্থ্য মানে কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করা। এই কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করার বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মানসিক স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা হল- একজন মানুষের এমন একটি অবস্থা যেখানে মানুষটি তাঁর দক্ষতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারেন, জীবনের বিভিন্ন চাপকে মোকাবেলা করতে পারেন, অর্থবহ জীবন যাপন করতে পারেন, এবং সমাজে অবদান রাখতে পারেন। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, এখানে একজন মানুষের কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারাটাই ফলাফল হিসেবে উঠে এসেছে এবং এটার চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে সমাজে অবদানের কথাটিতে জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ, মানসিক স্বাস্থ্য যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, তেমনি এইটি একই সাথে সামাজিক বিষয়ও।

মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যাবতীয় কিছুই বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেই হয়ে থাকে। এটা সত্য যে, সবকিছু এখনো শতভাগ নিশ্চিত করে নির্ধারণ করা যায় নি- তবে সেটাও যে বৈজ্ঞানিক ভাবে একদিন নির্ধারণ করা হবে সেটা সুনিশ্চিত। তাই, এখানে রোগ হওয়ার পিছনে যেমন বৈজ্ঞানিক ভাবে স্বীকৃত কারণ আছে- কোন রহস্যময়তা বা অলৌকিক কিছু নেই। এখানে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও মনগড়া বা অলৌকিক কোন কিছুর সুযোগ নেই। বিষয়টি সকলের মনে রাখা দরকার।Magazine site adsতবে যে ব্যাপারটা নিয়ে বেশী ধোঁয়াশা কাজ করে মানুষের মনে সেটি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের সামাজিক দিক। সামাজিক অনেকগুলো নিয়ামক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। এই সব নিয়ামকের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে, মানসিক রোগ তৈরী করতে পারে, এবং ভালো হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করতে পারে। ধরা যাক, মৌলিক অধিকারগুলোর যেখানে নিশ্চয়তা নেই, অর্থাৎ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার অপ্রতুলতা বা নাগালের বাইরে; সেখানে যতই চিকিৎসা করা হোক বা অন্য সহায়তা দেয়া হোক, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকার কোন সুযোগ নেই। এমনকি এসব এর নিশ্চয়তা মোটামুটি থাকলেও যেখানে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই, স্বাভাবিক মৃত্যুর যেখানে নিশ্চয়তা নেই, সেই মৃত্যু উপত্যকায় বসবাস করা কোন মানুষের- সে যেই অবস্থানেই থাকুক না কেন- মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকা সম্ভব নয়। অন্যদিকে কোন সমাজ যদি মনে করে মানসিক বিষয়গুলোকে অত গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই, মানসিক সমস্যার কারণ অতিপ্রাকৃতিক কিছু, মানসিক রোগ বলতে কিছুই নেই, মানসিক সমস্যার সমাধান শাস্তি দেয়া বা জোর করে বাধ্য করা বা বুজরুকি চিকিৎসা – তাহলে মানসিক সমস্যা চিহ্নিত করা, সমাধান করা এবং প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক উভবিধ কারণকে সরাসরি চিহ্নিত করা যায়। যেমন জেন্ডার এর ভিন্নতা। দেখা যাচ্ছে মহিলাদের মধ্যে বিষণ্ণতার মাত্রা পুরুষদের তুলনায় বেশি। এর পিছনের কারণ হিসেবে যেমন হরমোন জনিত কিছু বিষয় দায়ী, তেমনি তুলনামূলক বেশি যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া, সামাজিক বৈষম্যের শিকার হওয়া, অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থান, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব পাওয়া সহ বিভিন্ন সামাজিক নিয়ামক দায়ী।

আর তাই, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বিশেষত মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যবস্থাপনায়, একটি পদ্ধতি বা Approach বহুল জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে- যার নাম বায়ো-সাইকো-সোশ্যাল (Bio-psycho-social) এপ্রোচ। এখানে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়ার পিছনে কিছু শারীরবৃত্তিক, কিছু মনস্তাত্ত্বিক এবং কিছু সামাজিক কারণের উপস্থিতি স্বীকার করে নেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- বংশগত কারণ, মস্তিষ্কের সমস্যা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার অভাব, পারিবারিক বা সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া প্রভৃতি। একইভাবে, যেকোন ধরণের মানসিক সমস্যার জন্য অবস্থাভেদে প্রয়োজন হয় শারীরবৃত্তিক যেমন ঔষধপত্র, মনস্তাত্ত্বিক যেমন কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি, এবং সামাজিক যেমন পুনর্বাসন জাতীয় ব্যবস্থাপনা। ফলে, এসব থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য একইসাথে বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বিষয়।

অতএব, আমাদের মনে রাখতে হবে- মানসিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে ‘স্বাস্থ্য’ হয় না। এবং মানসিক স্বাস্থ্য একইসাথে বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বিষয়। তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে এই উভবিধ প্রেক্ষাপট সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।

  • এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
  • চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
    মগবাজার রেইল গেইট।
    নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
    (ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
    চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০

আরও পড়ুন-

Previous articleপ্রিয়জনের মৃত্যুতে নিজের মৃত্যুকাঙ্ক্ষা
Next articleমাথাব্যথার কারণ কি কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here