মানসিক রোগ চিকিৎসা পদ্ধতিগত পার্থক্য

মানসিক রোগ চিকিৎসা পদ্ধতিগত পার্থক্য

মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা-পদ্ধতির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। অতীত ঘাটলে দেখা যায় শুরুতে মানসিক রোগকে ভাবা হতো অপদেবতা বা ভূত-প্রেতের প্রভাব এবং স্বভাবতই এর চিকিৎসা-পদ্ধতিও ছিল অনেকটাই অমানবিক। জেলবন্দি করে রাখা হতো তখন।

পরবর্তীতে জেলের পরিবর্তে অ্যাসাইলাম বা পাগলাগারদের প্রচলন হলেও ঔষধ কিংবা মানবিক কোনো চিকিৎসাই তারা তখন পেতেন না। ফিলিপ পিনেল এবং ডারথা ডিক্সের হাত ধরে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র একসময় মানবিক হতে শুরু করল মানসিক রোগীদের প্রতি। অ্যাসাইলাম বন্ধ হলো। শুরু হলো মানসিক রোগের মানবিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা।

জীবনের বিভিন্ন বয়সে নানা ধরনের চাপের কারণে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। নানা বয়সে চাপের যেমন ভিন্নতা রয়েছে তেমনি মানসিক সমস্যার ধরনটাও চাপভেদে ভিন্ন। শুধু তাই নয়, একই ধরনের মানসিক সমস্যার প্রকাশটাও ভিন্ন হতে পারে বয়সভেদে। যেমন: শিশু-কিশোর, পরিণত ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিষণœতার লক্ষণগুলো আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশ পেতে পারে যেমনটা অন্যান্য মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও একই।

১২এডিএইচডি, ওডিডি, স্কল ফোবিয়ার মতো সমস্যাগুলো এ  সময় দেখা দিতে পারে। শিশুরা তাদের সমস্যাগুলো বড়দের মতো প্রকাশ করতে পারে না। তাই তাদের আচরণ আমাদের খেয়াল রাখা জরুরি। আচরণের পরিবর্তনগুলো অনেকক্ষেত্রেই মানসিক রোগের লক্ষণ বহন করে ও এর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।

শিশুদের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপর্ণ অংশ হচ্ছে সাইকোথেরাপি। প্লে-থেরাপি, বিহেভিয়র থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি, ইন্টারপারসোনাল থেরাপি, একসেপ্টেন্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট থেরাপি, সাপোরটিভ থেরাপি শিশুর বিভিন্ন মানসিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপর্ণ কয়েকটি সাইকোথেরাপি।

শিশুদের ক্ষেত্রে ঔষধ ব্যবহার পরিণত বয়সের মতো এতটা সহজ নয়। তাছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে ঔষধ ব্যবহারের পরিধি ও নিরাপদ মাত্রা কতটকু তা নিয়ে গবেষণালব্ধ ফলও পর্যাপ্ত নয়। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে ঔষধ ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে ঔষধ ব্যবহার করতে হবে এবং সেইসঙ্গে পরিবারের সঙ্গে রোগ ও রোগের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলা জরুরি।

বিশ্বে প্রতি ৬ জনের ১ জন ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। কৈশোর ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই জটিল একটি সময়। বয়ঃসন্ধিকালের এই সময়ে তারা খুব বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। শিশু হতে পরিণত বয়সে যাওয়ার পথে নানাবিধ চাপ ভর করে এ সময়ে। একা চলতে পারার চাপ, বন্ধুদের চাপ, পড়াশোনার চাপ তাদেরকে অনেক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে।

গবেষণা বলে অর্ধেকেরও বেশি মানসিক সমস্যা শুরু হয় ১৪ বছরের নিচে। গবেষণা আরো বলে ফোবিয়া, বিষণ্ণতা কিংবা শুচিবাই রোগের কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা দেয় ২৪ বছরের নিচে। ১০-১৯ বছর বয়সে মুত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি আত্মহত্যা। আবার আত্মহত্যার প্রধান কারণ বিষণ্ণতা। সতরাং জীবনকে গড়ে তোলার এ সময়টা পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে গুরুত্বসহকারে। এ সময় শিশুদের মতোই সাইকোথেরাপি মানসিক রোগ চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ।

বিহেভিয়র থেরাপি, কগনেটিভ থেরাপি, কগনেটিভ বিহেভিয়র থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি, ইন্টারপারসোনাল থেরাপি, সাপোরটিভ থেরাপি, মাইন্ডফলনেস মেডিটেশন থেরাপি রোগভেদে এ সময় প্রয়োজন হতে পারে।

এ সময়ও জটিল মানসিক রোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া কিংবা বাইপোলার রোগ দেখা দিতে পারে। তাই ঔষধেরও ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে তার সন্তানের সমস্যার ব্যাপারে ও তার ঔষধের ব্যাপারে জানানো জরুরি। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পরিবারকে ধারণা দিয়ে রাখতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঔষধ ও সাইকোথেরাপি একইসঙ্গে চালাতে হতে পারে।

শিশু ও কিশোর বয়সে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় তবে জটিল রোগে ও রোগের তীব্রতার ধরন অনযায়ী অনেক সময় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।

কিশোর পেরিয়ে পরিণত বয়সে অনেক সময় দায়িত্বের চাপ বেড়ে যায়। এছাড়া এ সময় অনেকের কিছ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয় অনেক জটিল মানসিক রোগের সূচনা এ বয়সে হতে পারে। তবে এ সময় ব্যবহৃত ঔষধের গবেষণালব্ধ ফল অনেক ক্ষেত্রেই আছে। তাই এ সময় চিকিৎসা করাটা তুলনামূলক ভাবে সহজ।

জটিল রোগে হাসপাতালে রেখে ঔষধ এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। সেইসঙ্গে সাইকোথেরাপিও চালানো যেতে পারে। ঔষধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি রোগের তীব্রতা কমাতে বেশ কার্যকর। পরিণত বয়সে জটিল মানসিক রোগী প্রায়শই খবু ভায়োলেন্ট হয়।

শারীরিক সক্ষমতা এদের ভায়োলেন্ট আচরণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। তাই এসব ক্ষেত্রে শুরুতে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানোই ভালো। কারণ, এসব রোগীর চিকিৎসা চালানোর জন্য অনেক সময় রিস্টেইন করার প্রয়োজন পড়ে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় ভালো না হলে ইসিটি বা ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপিও দেয়া যেতে পারে যা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে দেয়া হয়।

চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, তাই মৃত্যুর হার কমছে আর সেইসঙ্গে বাড়ছে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা। আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক পরিবর্তন, প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন আমাদের প্রবীণদের করে তলছে নিঃসঙ্গ। তাছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক ও শরীরের সক্ষমতাও কমতে থাকে। দেখা দেয় নানাবিধ শারীরিক রোগ।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৭০ বছরের মধ্যে ব্রেইনের ওজন পাঁচ শতাংশ কমে যায়। ৮০ বছরে দশ শতাংশ এবং ৯০ বছরে কমে প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে স্মরণশক্তি কমে যেতে থাকে। মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন ও শারীরিক বিভিন্ন রোগ প্রভাব ফেলে মনে। দেখা দিতে পারে বিষণœতা, দশ্চিন্তাগ্রস্ততার মতো মানসিক রোগ।

সেইসঙ্গে জটিল মানসিক রোগগুলোও ছাড় দেয় না এই বয়সে। প্রয়োজন পড়ে মানসিক রোগ চিকিৎসার। শারীরিক সক্ষমতা কমে যাওয়া ও জটিল অন্যান্য রোগের উপস্থিতি এই সময় চিকিৎসাকে করে তোলে জটিল।

রোগের তীব্রতা অনুযায়ী হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়তে পারে। ঔষধ কিংবা ইনজেকশন দুই ভাবেই চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। তবে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাথায় রাখতে হবে। ডিমেনশিয়া, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের সমস্যা অনেক চিকিৎসাকেই জটিল করে ফেলে।

তাই মানসিক রোগকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা একইসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া জরুরি। ঔষধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপিরও ভূমিকা বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রেও রয়েছে। সাইকোএডকেশন, ফ্যামিলি থেরাপি, পরিবারের সমর্থন প্রায় সব বয়সী রোগীদের জন্য খবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতি চারজনের একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় মানসিক সমস্যায় ভোগে। অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগীদেরও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় মানসিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে মানসিক রোগীকে শুরুতেই ভালো করা সম্ভব।

কিন্তু মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অবহেলা ব্যাপকভাবে কাজ করে যা মানসিক রোগ চিকিৎসায় বিরাট প্রতিবন্ধক। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ছাড়া পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না। তাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ

সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন।

Previous articleএকাকীত্ব দূর করতে করণীয়
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নার্সের ভূমিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here