মায়ের মাদকাসক্তি সন্তানের জন্য বিপজ্জনক

মায়ের মাদকাসক্তি সন্তানের জন্য বিপজ্জনক

সোহানা ভালোবেসে বিয়ে করে সুমনকে। তারা একই ইউনিভার্সিটির তিন ব্যাচ জুনিয়র-সিনিয়র। ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতে দিতেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা। আড্ডা আর গানের ফাঁকে টুকটাক সিগারেটও চলত, বিশেষ দিনে গাঁজাও চলত। তবে কেউ ঠিক মাদকাসক্ত ছিল না। তাই তো, ভার্সিটি লাইফ ভালোভাবে শেষ করে তারা মোটামুটি একটা ভালো পজিশনেই যায়। সোহানা ও সুমনের সংসারও ভালোই চলতে থাকে। সুমন বন্ধুদের আড্ডায় সিগারেটের পাশাপাশি অল্পসল্প গাঁজা খেলেও বাসায় দু-একটা সিগারেট ছাড়া কিছু খেত না। আর, সোহানা বিয়ের পর সবই ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিয়ের বছরখানেক পর থেকে তাদের মধ্যে প্রথমে পারিবারিক এবং পরে ব্যক্তিগত ঝামেলা শুরু হয়। দাম্পত্য এবং পারিবারিক এই কলহের চাপ সোহানা ঠিক সামলাতে না পেরে প্রথমে সিগারেট এবং পরে গাঁজাও সেবন শুরু করে। সুমন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও ঠিক পাত্তা দেয় না, ভাবে বাচ্চা নিলে ঠিক হয়ে যাবে। সন্তান পেটে আসার পর প্রথম কয়েক মাস ভালোই কাটে। কিন্তু অতিরিক্ত নিয়ম পালন করতে গিয়ে সোহানার মানসিক চাপ আরো বেড়ে যায়, সে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করে, কীভাবে যেন গাঁজাও মাঝেমাঝে ম্যানেজ করে। সুমন বিষয়টা টের পেলেও সন্তান প্রসবের আগে সোহানাকে অতিরিক্ত চাপ দেয় না। বড়ো কোনো ঝামেলা ছাড়া সন্তান প্রসব হওয়ার পর যথাযথভাবে সন্তান পালন করতে গিয়ে সোহানা আরো খিটমিটে হয়ে যায়। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ঝামেলা না কমে, আরো বেড়ে যায়।

দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক আর স্বাভাবিক থাকে না, হাতাহাতিও হয় কয়েকদিন। সোহানার সিগারেটের পাশাপাশি গাঁজা সেবনও বাড়তে থাকে, কীভাবে যেন ইয়াবাও খাওয়া শুরু করে। এতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে ছোট বাচ্চার ওপর। বাচ্চাকে ঠিক যতটা যত্ন করার কথা, সময় দেয়ার কথা তা তো দেয়া হয় না, উল্টো বাচ্চাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে এখন বাধছে না। সুমন বুঝতে পারে তার স্ত্রী মাদকাসক্ত, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেনি। পারিবারিক এবং সমাজের ভয়ে রিহ্যাবে দিতেও সাহস পায়নি। উল্টো, সে নিজেই হতাশায় পড়ে নেশায় আসক্ত হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটার এখন দুই বছর বয়স চলে, তার সঙ্গে পিতা-মাতার বন্ধন দৃঢ় করার এখনই সময়, অথচ তারা দুজনেই এক অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে চলছে। তাদের সম্পর্কটা ডিভোর্সের দিকেই যাচ্ছে, পাশাপাশি বাচ্চাটার স্বাভাবিক শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশ অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

নারীর মাদকাসক্ত একটা নতুন বৈশ্বিক সমস্যা। পুরুষদের দিয়ে শুরু হলেও নারী মাদকাসক্তের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে দেশে। সাধারণত পরিবারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং পরিবারের অন্য মাদকাসক্তের উৎসাহে নারীরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পারিবারিক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সাময়িক প্রশান্তি খুঁজতে বহু নারী মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে নারী ১৩ লাখের বেশি। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে নারী প্রায় চার লাখ। ঐ জরিপে বলা হয়, মাদকাসক্ত নারীর ৮০ শতাংশের আসক্ত হয়েছে বন্ধুদের মাধ্যমে। নারীরা পুরুষের থেকে সংখ্যায় কম আসক্ত হলেও নারীদের ক্ষেত্রে এর পরিণতি হয় ভয়াবহ; বিশেষ করে সামাজিক, মানসিক, শারীরিক এবং আচরণগত অবনতি মারাত্মক রকমের হয়ে থাকে। এরকম পার্থক্য হওয়ার পেছনে নারীদের স্নায়ু উত্তেজক কিছু হরমোন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের প্রভাব অনেকটাই দায়ী।

এছাড়া বাংলাদেশের নারীদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। মাদক গ্রহণে নারীরা পুরুষের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি বিষণ্ন হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত নারীর অনেকেই কিডনি সমস্যায় ভোগেন। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে মাদকাসক্তদের জন্য। মাতৃত্ব একটা ২৪ ঘণ্টার সার্বক্ষণিক দায়িত্বের বিষয়। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই বিশাল মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন। অপরদিকে মাদক কখনো কখনো সাময়িক সময়ের জন্য চাপমুক্ত করে। তাই, ইদানীং অনেক মায়েরা এই মাদকের দিকে ঝুঁকে থাকেন। যেসকল নারীরা মাদকে আসক্ত হয়ে যান, তারা স্বাভাবিকভাবে সন্তান লালন-পালন করতে পারেন না এবং প্রাকৃতিকভাবে শিশুর সঙ্গে মায়ের সংযোগ এবং আত্মিক বন্ধন যেভাবে গড়ে ওঠার কথা ঠিক সেভাবে হয় না। শিশু যখন বড় হতে থাকে তখন তার মানসিক, সামাজিক বিকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে তার পরিবার, আর পরিবারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে মায়ের। কিন্তু মা যদি মাদকাসক্ত থাকেন, তাহলে তার প্রভাব সরাসরি পরিবারের শিশুর ওপর পড়ে এবং শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। গর্ভের বাচ্চার ওপর প্রভাব গর্ভকালীন সময়ে মাদক নিলে জরায়ুর ভেতরের পরিবেশ, মায়ের আচরণ এবং মাদকের প্রভাবে গর্ভের বাচ্চার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। জন্মের পরপর বাচ্চা মাদক প্রত্যাহারজনিত সমস্যায় পড়তে পারে। এতে অস্থিরতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া বাচ্চার মস্তিষ্কের গঠনের সমস্যা, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা, বিকলাঙ্গতা, এমনকি জরায়ুর ভেতর মৃত্যুও হতে পারে। নবজাতক ও কম বয়সী শিশুদের ওপর প্রভাব বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার পর শিশুর সর্বোচ্চ পর্যায়ে মায়ের যত্ন প্রয়োজন, কিন্তু ঠিক এই সময়েই অনেকে মাদকের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। শরীরের হরমোনাল পরিবর্তনের ফলে এরকমটা হতে পারে। ব্রেইনের ডোপামিন এবং অক্সিটোসিন রিউয়ার্ড সিস্টেম বাচ্চা লালনপালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাচ্চাকে আদর করা, তার সার্বক্ষণিক চাহিদা পূরণ করা, খাওয়ানো, উষ্ণতা বিনিময় করা ইত্যাদিতে স্বর্গীয় সুখ অনুভব উক্ত রিউয়ার্ড সিস্টেমের ফল বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মাদক গ্রহণ একই রিউয়ার্ড সিস্টেমকে উত্তেজিত করে, এতে তা স্বাভাবিকভাবে কাজ না করে উল্টোভাবে কাজ করে।

নিজের শিশুর জায়গা মাদক দখল করে নেয়, ফলে শিশুর প্রতি স্বাভাবিক আচরণ না করে, মাদকে গ্রহণের দিকেই মা ঝুঁকে পড়েন। বাচ্চা পালনের দায়িত্বকে অতিরিক্ত চাপ মনে করেন, সেই চাপ কমানোর জন্য আরো বেশি করে মাদক গ্রহণ করতে থাকেন। ফলে মা-সন্তানের স্বাভাবিক যে যোগাযোগ এবং বন্ধন তা গড়ে ওঠে না। শিশু যখন কথা বলা শিখতে শুরু করে, চারপাশের মানুষ ও পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও সংযুক্ত করতে শুরু করে তখন তার মাকেই বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু মাদকাসক্ত মা নিজেই আচরণগত এবং আবেগীয় সমস্যায় ভুগতে থাকেন, ফলে শিশুর সঙ্গে তার সঠিক সংযোগ ঘটে না, শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া শিশুরা পরিবারের সদস্যদের আচরণ দেখে শেখে বেশি। তাই এই সময় মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, বিষণ্ন হয়ে পড়া ইত্যাদি দেখে শিশুরাও সেরকম হয়ে যেতে পারে।  স্কুলগামী এবং বড়ো শিশুদের ওপর প্রভাব মাদক গ্রহণ মায়েদের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো দূর্বল করে দেয়; সঙ্গীর সঙ্গে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এবং অবশ্যই বাচ্চার সঙ্গে সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এর ফলে তারা অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, পরিবার এবং সমাজের সাহায্য কম পায় এবং বিভিন্ন প্রকার সমস্যার মুখোমুখি হয়। যেমন: পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি। এই সময় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায় পুরুষ সঙ্গী দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতে তার মানসিক চাপ কমানোর জন্য সে আরো বেশি করে মাদকের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরিবারের স্বাভাবিক কাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়ে। এর ফলে শিশুরা মারাত্মক অবহেলা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। যেমন: তারা অনেকেই আচরণগত সমস্যায় ভোগে, অন্য শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না, হীনমন্যতায় ভোগে, পড়ালেখায় স্বাভাবিক উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, কেউ কেউ বিষণ্ন হয়ে পড়ে, অনেক শিশুরা মাদকের দিকে সহজেই ঝুঁকে পড়ে, আবার কারো মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা খুব বেড়ে যায়।

অনেকেই যথাযথ পারিবারিক অনুশাসন না পেয়ে বিভিন্ন অসামাজিক এবং রাষ্ট্র ও আইন বিরোধী কাজেও জড়িয়ে পড়ে। মা ও সন্তানের সম্পর্ক জন্মের আগে থেকে শুরু হয় আর এটি পূর্ণতা পায় সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। একটি সুন্দর সম্পর্ক শুধু সুস্থ মানসিক বিকাশে সহায়তা করে না, এটি শিশুর ভেতরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। এমনকি শিশুর মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে মা-শিশুর সুন্দর সম্পর্ক। কিন্তু মা যদি মাদকাসক্ত হন, তাহলে তিনি নিজে যেমন বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন, তার পরিবার এবং সন্তানরাও মারাত্মকভাবে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যায়। সন্তানের সঠিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই নিজের সুস্থতার জন্য এবং শিশুর সুন্দর জীবনের জন্য মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের সাহায্যও নিতে হবে।

লেখক ডা. মেজবাউল খাঁন ফরহাদ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে  

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleকরোনায় মানসিকভাবে সুস্থ থাকার উপায়
Next articleকারো সাথে কথা বলতে ভয় লাগে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here