বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ও মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ

১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছরই এ দিনটিকে কেন্দ্র করে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষনে একটি শ্লোগান ধার্য্য করা হয়। বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরের শ্লোগান ছিল ‘Dignity in mental health : মানসিক  স্বাস্থ্যে  মর্যাদাবোধ’।

মূলতঃ স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করলে দেখা যায় যে, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পূর্ণতাই হচ্ছে স্বাস্থ্য। কাজেই সুস্থতার বিবেচনায় শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি  মানসিক সুস্থতাও সমানভাবে বিবেচ্য। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বিশ্বে সাধারণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৮ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থ যা আমাদের দেশে প্রায় ১৬ শতাংশ। কিন্তু অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জকভাবে পরিলক্ষিত হয় যে, এ ১৬ শতাংশ মানসিক রোগীই পারিবারিক তথা সামাজিক পর্যায়ে বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানসিক রোগী মানেই অবহেলার পাত্র, তাদের চিকিৎসা করানোর কোনো প্রয়োজন নেই, চিকিৎসায় এ রোগ ভালো হয় না, এটা আসলে অভিশাপের ফল, বান দেয়া, বাতাস লাগা ইত্যাদি খুবই প্রচলিত ব্যাখ্যা। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই মানসিক রোগেরও বিভিন্ন কারণ রয়েছে যার মধ্যে বংশগত, পরিবেশগত, সামাজিক, জৈবিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মানুষের শরীরের  কিছু রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতিও মানসিক রোগ সৃষ্টিতে দায়ী। যদিও অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগেরও বিজ্ঞানসম্মত  চিকিৎসা রয়েছে তবুও মানসিক রোগীদেরকে তাবিজ. পানি পড়া, তেল পড়া জাতীয় অপচিকিৎসার দিকে ঠেলে দেয়া হয়।  শিক্ষা, চাকুরী, পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে তাদের ভি্ন্ন চোখে দেখা হয়।

অধিকাংশ মানসিক রোগীই চিকিৎসার ফলে পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে। আবার মানসিক রোগের একাংশের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা। সর্বোপরি চিকিৎসা মাধ্যমে একজন মানসিক রোগী অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো মর্যাদার সাথে স্বাভবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু এ স্বাভবিক জীবন পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসার প্রতি সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস, ভুল ধারনা, কুসংস্কার আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

মর্যাদাবোধ মানুষের এমন একটা জন্মগত অধিকার যার সাথে তার আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয় জড়িত। যেখানে প্রতিটি মানুষেরই এ মর্যাদা পাওয়ার অধিকার আছে সেখানে মানসিক রোগীরা সামাজিক কুসংস্কার ও ভেদাভেদের কারণে তার এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাদেরকে এখনও পারিবার, সামাজ তথা সর্বক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়। মানসিক রোগ বলে তাদের পিছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করা হয়। আর যদিও বা কেউ কেউ  মানসিক  রোগকে গুরুত্ব দিতে চান, তারপরও তারা নানা সামাজিক কারণে কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে অনিচ্ছুক থাকেন। ফলে এসব রোগীরা মানসিক সুস্থতার পরিবর্তে অন্ধকারেই থেকে যায় দিনের পর দিন। কালো ছায়ায়  নিমজ্জিত হয় তাদের ভবিষ্যৎ।

monon-600

কাজেই অপচিকিৎসার কবল থেকে মুক্ত করে একজন মানসিক রোগীকে অন্যান্য রোগীদের মতো বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসার আওতায় নিয়ে এসে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প আর কিছুই নেই। মানসিক স্বাস্থ্য তথা মানসিক রোগের মর্যাদাবোধের লক্ষ্যে একটি পরিবারের পাশপাশি সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। মনোরোগ চিকিৎসকের পাশাপাশি অন্যান্য সকল চিকিৎসকদেরকেও মানসিক রোগীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সামাজিক সুবিধাসমূহ সমৃদ্ধ করে একজন মানসিক রোগীর অধিকার, চাহিদা, সম্মান তথা মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে হবে। যতদ্রুত সম্ভব সব ভ্রান্ত ধারণা দূরে ঠেলে, সকল কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙ্গে মানসিক রোগীদের সুস্থতায় পরিপুর্ণ হতে সাহায্য করতে হবে। তাদেরকে চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা, চাকুরী সহ সকল সামাজিক সুযোগ সুবিধার আলোয় আলোকিত করার নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এটাই উপযুক্ত সময়।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleমাদকাসক্তদের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা
Next articleসুখী হোন বিবাহিত জীবনে: দাম্পত্য সম্পর্কে সহিংসতা ও শান্তি- পর্ব ৫
অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here